তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু
রাজধানীর কাকরাইল মোড়ে ট্রাকের চাপায় মারা গেলেন কালের কণ্ঠের সাবেক ডেপুটি এডিটর আব্দুল্লাহ আল ফারুক। শনিবার রাত দেড়টার দিকে ট্রাকের চাপায় গুরুতর জখম হন। পরের দিন রবিবার সকাল ৮টায় রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে মারা যান প্রতিথযশা এই সাংবাদিক।
ফারুক ভাইয়ের আগে একই স্থানে রোড এক্সিডেন্টে মারা যান আরেক সাংবাদিক দীনেশ দা। তিনি কাজ করতেন আমাদের সময় পত্রিকায়।
দু’জনই মারা যান বেকার অবস্থায়। কোনো কারণ ছাড়াই অনেকটা বিনা দোষে চাকরিচ্যুত হন এই দুই সাংবাদিক। এ ধরনের মৃত্যু সংবাদে আমাদের চোখ ভারী হয়ে উঠে। এভাবে আমি বা আমরা কখন চাকরিচ্যুত হই বা করি জানি না। শুধু জানি, এই অসহায় বেকারত্বের মধ্যে বসবাস আমাদের ক্রমেই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। বেকারত্বকালীন যে গভীর হতাশা তৈরি হয় তাতে স্বাভাবিক চলাচলের গতি রুদ্ধ হয়ে যায়। বেকারত্বকালীন একজন মানুষ হয়ে যান অর্ধমৃত। ঢাকা শহরে বাড়ি ভাড়া, ছেলে-মেয়েদের লেখা-পড়ার ব্যয়, বাজার খরচ মেটাতে না পারার যে যন্ত্রণা, যে অসহায়ত্ব কাজ করে- তা প্রতি মুহূর্তে একজন বেকার সাংবাদিককে কুরে কুরে খায়। এরই বহিঃপ্রকাশ মানসিক উৎকণ্ঠা নিয়ে এলোমেলো পথ চলা। যার নির্মম পরিণতি হচ্ছে রাজপথে চলা দানব বাস-ট্রাকের তলায় অসহায় মৃত্যু।
আমার সঙ্গে ফারুক ভাইয়ের ঘনিষ্ঠতা খুব বেশি ছিল না। তিনি যখন কালের কণ্ঠের চিফ রিপোর্টার আমি তখন সেখানকার বিজনেস বিটের রিপোর্টার। আমার বস টিটু দা। তাই ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ কম হতো। তারপরও ফারুক ভাইয়ের জন্য কোথায় যেন গভীর মমতা কাজ করতো।
আমি যখন এই লেখা লিখছি তখন আমার হাতেই চাকরিচ্যুত হয়েছেন কয়েকজন সাংবাদিক। কোনো কারণ ছাড়াই চাকরিচ্যুত হয়েছেন তারা। তাদের সামনের দিনগুলো না জানি কত বিপদসঙ্কুল! আমার কোনো কৈফিয়ত নেই তাদের কাছে। শুধু রয়েছে কষ্ট আর গভীর বেদনা। শুধু বলতে পারি, আমিও অসহায়। আমারও হাত-পা বাঁধা। আমাকে ক্ষমা করে দিন।
পাভেল হায়দার চৌধুরী, কালের কণ্ঠের একজন তুখোড় রিপোর্টার ছিল। ফোনে বললো, ‘ফারুক ভাইকে বিনা দোষে চাকরিছাড়া করা হয়েছে। এ জন্যই এই মৃত্যু।’
পাভেল কাঁদছিল। ফোন কেটে দিলাম। আমিও চুপ। অনেকক্ষণ কাঁদলাম। বিনা দোষে কিছুদিন আগে পাভেলকেও চাকরি হারাতে হয়েছে। প্রায় এক বছর বেকার থাকার পর একটা চাকরি পেয়েছে পাভেল।
ফারুক ভাইয়ের বয়স হয়েছে। হাইপ্রোফাইলের সাংবাদিক। তার স্ট্যাটাসে এখন চাকরি পাওয়া কঠিন। তাই পাভেল চাকরি পেলেও কোনোভাবেই বেকারত্ব ঘোচাতে পারছিলেন না ফারুক ভাই। অসহায়ভাবে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ঘোরাঘুরি করতেন। একবার মিডিয়া রুমে তো আরেকবার বাগানে। বেশিরভাগ সময়ই একা একা বসে থাকতেন বিএনপি বিটের এক সময়ের জাঁদরেল এই সাংবাদিক। তার চোখে-মুখে গভীর হতাশা দেখেছি গেল বৃহস্পতিবার। দেখা হলেই একবার সালাম দিতাম। চুপচাপ সালাম নিতেন। আর কোনো কথা হতো না। ফারুক ভাই কথা বলতেন কম।
জহুর ভাই যিনি কালের কণ্ঠ থেকে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন, তিনি এখন দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমের মার্কেটিং ম্যানেজার। অফিসে এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ফারুক ভাই চিফ রিপোর্টার ছিলেন না?’
আমি বললাম, হ্যাঁ।
-‘তিনি স্যাকড হয়েছিলেন না?’
আমি বললাম, হ্যাঁ।
জহুর ভাই তখন বললেন, ‘এইতো সাংবাদিকের জীবন।’
উনিশ বছরের সাংবাদিকতা পেশায় আমি নিজেও বেকার হয়েছি কয়েক দফা। কত কষ্ট আর কী পরিমাণ অসহায় হয়ে যান একজন সাংবাদিক সেটা মর্মে মর্মে বুঝেছি। বুঝেছি, আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। বর্তমানটাও খুব বেশি অনিশ্চিত। চাকরি, বেতন ও জীবন এই তিন অনিশ্চয়তা নিয়েই সাংবাদিকদের চলতে হয়। জহুর ভাইয়ের ভাষায়- ‘এইতো সাংবাদিকের জীবন’।
তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু
সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকম