দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রাম আর অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নেয় স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ, বাংলাদেশ। এই বিজয়ে আনন্দের পাশাপাশি অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগ ও ত্রিশ লাখ শহিদের রক্তেভেজা মুক্তিযুদ্ধের কথা কখনো ভুলবার নয়। একাত্তরের এই মহান মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, যাঁরা জীবন দিয়েছেন সেইসব মুক্তিযোদ্ধাদের আর যে মহানায়কের বিচক্ষণ নেতৃত্বে আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হতে পেরেছি, সেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আজ গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। স্বাধীনতার পর চার দশক পার করেছে বাংলাদেশ।
একটি দেশ বা জাতির ইতিহাসে চার দশক হয়তো খুব বেশি সময় নয়, একটি প্রজন্মেরও কম। তবে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং জাতীয় অগ্রগতির জন্য এই সময়কাল তেমন কমও নয়। বাস্তবে স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতি বিগত চার দশকে অনেক সাফল্য যেমন অর্জন করেছে, তেমনি এর বেশকিছু ব্যর্থতাও আছে।
একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের পেছনে ছিল গভীর সব স্বপ্ন ও প্রত্যাশা। সেই স্বপ্নে ছিল অর্থনৈতিক ও সামাজিক শোষণ থেকে মুক্তি, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং আত্মনির্ভরশীলতার অঙ্গীকার। বাংলাদেশের অভ্যুদয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও নেতৃত্বে সংঘটিত হলেও একটি কথা মনে রাখতে হবে, এই স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল চালিকাশক্তি ছিল অর্থনৈতিক মুক্তির তীব্র আকাক্সক্ষা। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে চরম আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের কারণেই বেগবান হয়েছিল স্বাধীনতার সংগ্রাম।
ভাষা আন্দোলনের সুদৃঢ় আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যেসব আন্দোলন দানা বাঁধে সেগুলোর পেছনে বাঙালির অর্থনৈতিক বঞ্চনার অনুভূতি সক্রিয় ভূমিকা রাখে। তবে, ষাটের দশক থেকে এই অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বরূপ আরো স্পষ্টভাবে উদ্ঘাটিত হতে শুরু করে জনগণের কাছে। সে সময়কার কিছু দেশপ্রেমিক বাঙালি অর্থনীতিবিদের গবেষণা ও বিশ্লেষণে উঠে এসেছিল বৈষম্যের প্রকৃত চিত্র। তাঁদের হিসাব থেকেই জানা যায় যে, জনসংখ্যার দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তান বৃহত্তর অংশ হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় বাজেটের সিংহভাগ বরাদ্দ থাকতো পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। পূর্ব পাকিস্তান থেকে কর আদায় হতো এ এলাকার জন্য মোট বরাদ্দেরও বেশি। বৈদেশিক সাহায্যের বেশির ভাগ বরাদ্দ পেতো পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানের কৃষিপণ্য রপ্তানির (মূলত পাট ও চা) পুরোটাই ব্যয় করা হতো পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে।
১৯৭০ সালে নির্বাচনের একটি পোস্টারে অর্থনৈতিক বৈষম্যের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে বছরে রাজস্ব ব্যয় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে তিনগুণেরও বেশি। চাল, আটা ও তেলের দাম পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানে ছিল দ্বিগুণ। কেন্দ্রীয় সরকার ও সামরিক বিভাগের চাকুরির প্রায় ৯০ শতাংশই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের দখলে। কেবল অর্থনৈতিক শোষণ নয়, বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপরও নিপীড়ন নেমে আসে। এসব বৈষম্য ও বঞ্চনা পুঞ্জিভূত হয়ে ক্রমশ রূপ নেয় গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে, যার বহিঃপ্রকাশ ও সফল সমাপ্তি ঘটে একাত্তরের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে।
পশ্চিম পাকিস্তানের এসব শোষণ প্রতিরোধ করার লক্ষ্যেই ঐতিহাসিক ছয়-দফা উপস্থাপন করেন বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিক্ষুব্ধ বাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের সমুচিত জবাব দেয় সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে। ঐ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। তা সত্ত্বেও পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দিতে রাজি ছিল না। ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালের পুরো মার্চ মাস ধরেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে চলে অসহযোগ আন্দোলন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের মূল কথাটিও ছিল সকল ধরনের শোষণ থেকে মুক্তি। অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়টিও বেশ স্পষ্ট করেই উঠে এসেছিল তাঁর ঐ অতুলনীয় ভাষণে। উত্তাল মার্চের ২৬ তারিখের প্রথম প্রহর থেকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের পথচলা শুরু হয় আলো-আঁধারের মধ্য দিয়ে। আলোর দিকটি হলো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরাধীনতা থেকে মুক্তির যে অদম্য আকাক্সক্ষা ছিল বাংলাদেশের জনগণের, তা পূরণ হয়। আকাক্সক্ষা ছিল সামাজিক বৈষম্য দূর করা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশকে দারিদ্র্যমুক্ত, গতিশীল এবং উদার গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গড়ে তোলা।
আর আঁধারের দিকটি হলো উত্তরাধিকার সূত্রে বাংলাদেশকে একটি দারিদ্র্যপীড়িত ও ভঙ্গুর অর্থনীতির হাল ধরতে হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে শুধু দারিদ্র্যই ছিল না, দারিদ্র্য দূর করার জন্য যে হাতিয়ারগুলো থাকা প্রয়োজন, সেগুলোও বাংলাদেশের ছিল না। ছিল না অর্থ, অবকাঠামো কিংবা দক্ষ জনশক্তি। তখন বাংলাদেশের পরিচিতি ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ, অর্ধাহার-অনাহার কবলিত, বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক কাঠামোর একটি দরিদ্র দেশ হিসেবে। দেশের বন্দর, পরিবহন ব্যবস্থা ও শিল্প-কারখানা ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত। পাট ও চা এর মতো কয়েকটি পণ্যে সীমিত ছিল রপ্তানি বাণিজ্য। রেমিট্যান্স আসতো না। ছিল না বিদেশী মুদ্রার তেমন কোন রিজার্ভ।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের নাজুক ও ভঙ্গুর আর্থ-সামাজিক অবস্থা দেখে অনেকেই হতাশ হয়েছিলেন এবং এর স্থায়িত্ব নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার সত্তর দশকের বাংলাদেশকে বিদেশী সাহায্যনির্ভর ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। নরওয়ের অর্থনীতিবিদ ফাল্যান্ড ও ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ পারকিন্সন বাংলাদেশকে বলেছিলেন ‘উন্নয়নের পরীক্ষাগার’। ১৯৭৬ সালে তারা লিখলেন, ‘এ রকম পরিস্থিতিতে যদি বাংলাদেশের উন্নয়নের উদ্যোগ সফল হয়, তাহলে পৃথিবীর যে কোনো দেশেই এ ধরনের উদ্যোগ সফল করা যাবে’।
এই অর্থনীতিবিদদ্বয় ২০০৭ সালে তাদের পূর্ববর্তী অবস্থান থেকে কিছুটা হলেও সরে আসতে বাধ্য হন, ‘তিন দশক এবং তার বেশি সময়ের সীমিত ও বর্ণাঢ্য অগ্রগতির ভিত্তিতে মনে হয় বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়ন অর্জন সম্ভব’। অর্থাৎ এককালের নেতিবাচক ধারণা পোষণকারীরা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে এখন বাংলাদেশকে উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। নামকরা সব বিশ্ব গণমাধ্যমের চোখেও হালের বাংলাদেশের বিস্ময়কর অগ্রগতির ভঙ্গিটি প্রতিনিয়তই ধরা পড়ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণায় এখনো বাংলাদেশ উন্নয়নের পরীক্ষাগার, তবে ইতিবাচক অর্থে। এত কম মাথাপিছু আয়ের দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের সুসংহতকরণ এক সাথে চলতে পারবে কিনা, সুশাসনের অসম্পূর্ণতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব সত্ত্বেও এত প্রবৃদ্ধি হলো কেমন করে, রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার পর্যাপ্ত উন্নতি না হলেও এ রকম প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা যাবে কিনা, এসব বিষয়ে বাংলাদেশকে এখন উন্নয়নের পরীক্ষাগার বলা হচ্ছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বহুজাতিক বিনিয়োগ সংস্থা গোল্ডম্যান স্যাক্সের পূর্বাভাসের গ্রহণযোগ্যতা যথেষ্ট। এক দশক আগে সংস্থাটি চারটি দেশের সম্ভাবনার কথা বলেছিল। দেশগুলো ছিল ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া এবং চীন। তাদের পূর্বাভাস সত্যি হয়েছিল। পরবর্তীতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে যুক্ত করে এই অর্থনৈতিক জোটের নামকরণ হয় ব্রিকস (ইজওঈঝ)।
সম্প্রতি গোল্ডম্যান স্যাক্স সম্ভাবনাময় আরো ১১টি দেশের একটি নতুন তালিকা তৈরি করেছে। এ দেশগুলোর অর্থনীতিও এগিয়ে আসছে বলে এদের নাম দেওয়া হয়েছে ‘নেক্সট ইলেভেন’। এই উদীয়মান এগারটি দেশের অন্যতম বাংলাদেশ। সংস্থাটি বাংলাদেশ সম্পর্কে বলেছে, দেশটির বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যার বেশির ভাগই তরুণ। এদের মাধ্যমে দেশটির ভবিষ্যত বদলে দেয়া সম্ভব। আমারও বিশ্বাস, সচেতন তরুণ সমাজই বাংলাদেশের সম্ভাবনার প্রতীক। তাদের প্রত্যয়, প্রযুক্তিপ্রিয়তা, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সাহস ও দক্ষতাই বাংলাদেশকে দ্রুতলয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার সব ধরনের সুযোগ বাংলাদেশে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের পূর্বাভাসে বলেছে, ২০৩০ সাল নাগাদ ‘নেক্সট ইলেভেন’ সম্মিলিতভাবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২৭টি দেশকে ছাড়িয়ে যাবে। লন্ডনের জাতীয় দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, ২০৫০ সালে বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির বিচারে পশ্চিমা দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে যাবে। তাছাড়া, মুডি’স ও স্ট্যান্ডার্ড এন্ড পুওর’স গত কয়েক বছর ধরে ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশের সন্তোষজনক অর্থনৈতিক রেটিং দিয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রক্ষেপণও স্থিতিশীল ও সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের ইঙ্গিত বহন করে। বিশ্বখ্যাত সংস্থাগুলোর এসব পূর্বাভাসই প্রমাণ করে বাংলাদেশের সামনে রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা।
গত চার দশকের পথচলায় বাংলাদেশের অর্জনের তালিকা খুব ছোট নয়, বরং গর্ব করার মতো অনেক অর্জন রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি খাতের উৎপাদন, তৈরি পোশাক রপ্তানি ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স, যার পেছনে রয়েছে এ দেশের কৃষক, মেহনতি ও শ্রমজীবী মানুষের অবিস্মরণীয় অবদান। কৃষি প্রধান দেশ হলেও বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না। সত্তর দশকের প্রথম দিকে দেশে চাল উৎপাদন হতো এক কোটি টন। জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। উৎপাদিত খাদ্যে ষাট ভাগ চাহিদা মিটতো। বাকি খাদ্য আমদানি করতে হতো। অথচ বিদেশী মুদ্রার মজুদ ছিল সামান্য। তাই বিদেশীদের কাছে খাদ্য সাহায্যের জন্য নিয়মিত হাত পাততে হতো।
গত চার দশকে কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। কৃষকদের সৃজনশীলতা ও কঠোর পরিশ্রমের কারণে বাংলাদেশ বর্তমানে এক খাদ্য-বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। একাত্তরের তুলনায় খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে তিনগুণেরও বেশি। সরকারি হিসাবে দেশে চাল ভোগের পরিমাণ বছরে দুই কোটি ২০ লাখ টন আর উৎপাদন তিন কোটি ৫৭ লাখ টন। অর্থাৎ দেশে চাল উদ্বৃত্ত রয়েছে। গত দু’বছর ধরে বাংলাদেশ চাল আমদানির ইতি টেনেছে। উপরন্তু, উদ্বৃত্ত চাল রপ্তানি করা যায় কিনা তা নীতি-নির্ধারণী মহলে ভাবা হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন আর ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নয়, বরং ঐ ঝুড়ি এখন খাদ্য ও বিদেশী মুদ্রায় পরিপূর্ণ হয়ে উপচে পড়ছে।
বাংলাদেশে এখন আর দুর্ভিক্ষ হয় না। ‘মঙ্গা’ শব্দটিও দেশ থেকে নির্বাসিত। অল্প সময়ে এত বড় সাফল্য কৃষকরাই এনেছেন। মুক্তিযুদ্ধের মতই কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর সংগ্রামে কৃষকরা বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। তারাই আমাদের প্রকৃত বীর। কৃষি উন্নয়নে পুরুষের পাশাপাশি এগিয়েছেন নারীরাও। কৃষকদের সাথে যারা কৃষি খাতের সম্প্রসারণ ঘটিয়েছেন, নীতি-পরিকল্পনা নির্ধারণ করেছেন, কৃষির উন্নয়নে ঋণ দিয়েছেন-তাদের অবদানও কম নয়।
দেশের অর্থনীতির নবযাত্রায় গার্মেন্টস শিল্পের ভূমিকা অসামান্য। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প এভাবে দাঁড়াবে তা দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় কেউ ভেবেছেন বলে মনে হয় না। আমার মনে আছে সত্তরের দশকে কিছু টেইলারিং শপ গড়ে উঠেছিল কমলাপুর এলাকায়। সেখান থেকে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিকারক দেশ। এই অসামান্য সাফল্য গাথার অগ্রনায়ক ছিলেন দেশ গার্মেন্টসের বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল কাদের খান। বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানিতে এখন বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের ওপরে, একমাত্র চীনের পরেই তার অবস্থান।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত হচ্ছে এই পোশাকশিল্প। মোট রপ্তানি আয়ের ৭৮ শতাংশই আসছে এ খাত থেকে। প্রায় ৪০ লাখ শ্রমজীবী এ পেশায় নিয়োজিত, যার আশি ভাগই নারী এবং বেশির ভাগ শ্রমিকই এসেছে কৃষক পরিবার থেকে। শ্রমবাজারে এদের অংশগ্রহণ সামাজিক সূচক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে। মজুরি অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের তুলনায় বেশ খানিকটা কম হলেও এই শ্রমিকরা খুবই দক্ষ, কাজও করে অনেক বেশি। বাংলাদেশ এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে তুলনামূলক কম খরচে উন্নত মানের পোশাক তৈরি করে চলেছে। চীনেও পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি বাড়ছে। তাই তারা পোশাক শিল্পের মতো শ্রমঘন শিল্প থেকে তাদের বিনিয়োগ হাইটেক ও ভারী শিল্পের দিকে সরিয়ে নিচ্ছে।
তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক ক্রেতারাও এখন চীনের পরিবর্তে বাংলাদেশমুখী হচ্ছেন। বাংলাদেশকে সেই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। শুধু রপ্তানির জন্যই নয়, স্থানীয় বাজার চাহিদার কারণেও এ শিল্প দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বিকশিত হবে বলে আশা করা যায়। তবে, এর জন্য প্রয়োজন হবে ভূমি ও সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো। কাল বিলম্ব না করে গড়ে তুলতে হবে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল যাতে থাকবে জ¦ালানির নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ। থাকবে পর্যাপ্ত কানেকটিভিটি ও নিরাপত্তা।
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির সহিংসতায় আমাদের অগ্রসরমান রপ্তানি খাত বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে। এ পরিস্থিতির দ্রুত অবসান কাম্য। আর সেজন্য সকলকেই একযোগে কাজ করে যেতে হবে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এখন আমাদের অর্থনীতির অন্যতম ভরসা হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ যে টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে তার মূলে ভূমিকা রাখছে এই রেমিট্যান্স। স্বাধীনতার আগে বিশ্ব শ্রমবাজারে বাঙালি কর্মীর সংখ্যা ছিল একেবারেই নগণ্য। স্বাধীনতা যেন বিশ্বের কর্মদুয়ার খুলে দিয়েছে বাংলাদেশীদের জন্য।
বাংলাদেশের মানুষ আজ ছড়িয়ে পড়েছে দেশান্তরে। বাংলাদেশের একটি গ্রামও বুঝি এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে গ্রামের কিছু মানুষ বিদেশে কাজ করেন না। হালে নারী কর্মীরাও ব্যাপকহারে বিদেশে যাচ্ছেন। বর্তমানে পৃথিবীর দেড় শতাধিক দেশে কাজ করছেন বাংলাদেশের প্রায় ৮০ লাখ কর্মী। প্রতি বছর প্রায় ৬ লাখ কর্মীর বিদেশে কর্মসংস্থান হচ্ছে। রেমিট্যান্স প্রবাহের দিক দিয়ে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে সপ্তম এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এই রেমিট্যান্সের পরিমাণ আমাদের মোট জিডিপি’র ১০ শতাংশের বেশি, রপ্তানি আয়ের অর্ধেকের বেশি এবং প্রাপ্ত বৈদেশিক সাহায্যের প্রায় ১০ গুণ ।
২০১২ সালে প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ। বর্ণিত সময়ে রেমিট্যান্স এসেছে ১৪.২ বিলিয়ন ডলার। আর চলতি অর্থবছর শেষে রেমিট্যান্স ১৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা যায়। রেমিট্যান্স আকারে যে বিদেশী মুদ্রা আসছে তা কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়নে ব্যয় হচ্ছে। ফলে কৃষি ব্যবস্থা আধুনিকায়ন হচ্ছে। উৎপাদন বাড়ছে আশানুরূপভাবে। বিদেশী মুদ্রা রিজার্ভেও বিশেষ অবদান রাখছেন প্রবাসী কর্মীরা। তাদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের কল্যাণে চলতি বছরের শুরুতেই বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে।
রিজার্ভ মার্চ মাসের শুরুতেই ১৪ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড ভেঙ্গেছে। আমাদের মতো একটি দেশের বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ ‘ডাবল ডিজিটে’ স্থিতিশীল রাখতে পারাটা নিঃসন্দেহে বিরাট এক সাফল্য। বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের মতো আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। আসুন বিগত দিনের ব্যর্থতা ভুলে নতুন করে এগিয়ে যাবার শপথ নিই, কাজ করি স্বদেশের জন্য। ষোল কোটি বাঙালির বত্রিশ কোটি হাতকে কাজে লাগাই দেশ-জাতির কল্যাণে। এই মাটি ত্রিশ লাখ শহিদের রক্তে ভেজা পবিত্র ভূমি। আমাদের বীর সেনানীরা দেশ-জাতির মুক্তির জন্য জীবন দিয়েছিলেন। আমাদের মনে রাখতে হবে দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু দেশের মানুষ প্রকৃত অর্থে এখনও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে পারেননি।
অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য দরকার একটি অর্থনৈতিক বিপ্লব। এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে আমাদের তরুণ সমাজকে। তরুণ যোদ্ধাদের হাতেই মুক্তি পাবে গণমানুষের আকাক্সক্ষা, তাদের ত্যাগের মহিমায় প্রিয় মাতৃভূমি হয়ে উঠবে সুখ-স্বাচ্ছন্দের আকর। তারা যে এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে সক্ষম সে ইঙ্গিত এরই মধ্যে দিতে সক্ষম হয়েছে। শুভ হোক তাদের পদচারণা। ঘটুক আমাদের সকলের মাঝে দেশপ্রেমের পূর্ণ জাগরণ। কথায় জাগরণ, কাজে জাগরণ, লেখায় জাগরণ, ভাবনায় জাগরণ। সবমিলে জাগ্রত বাংলাদেশ হবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশে মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্র দিন দিন প্রসারিত হতে থাকবে। সেটিই একটি জাতির উন্নয়নের প্রধান লক্ষণ। ঠিক যেমনটি বরীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘....যে-জাতি উন্নতির পথে বেড়ে চলেছে তার একটা লক্ষণ এই যে, ক্রমশই সে জাতির প্রত্যেক বিভাগের এবং প্রত্যেক ব্যক্তির অকিঞ্চিৎকরতা চলে যাচ্ছে। যথাসম্ভব তাদের সকলেই মনুষ্যত্বের পুরো গৌরব দাবি করবার অধিকার পাচ্ছে। এই জন্যেই সেখানে মানুষ ভাবছে কি করলে সেখানকার প্রত্যেকেই ভদ্র বাসায় বাস করবে, ভদ্রোচিত শিক্ষা পাবে, ভালো খাবে, ভালো পরবে, রোগের হাত থেকে বাঁচবে এবং যথেষ্ট অবকাশ ও স্বাতন্ত্র্য লাভ করবে।’ (‘বাতায়নিকের পত্র’, বরীন্দ্ররচনাবলী, দ্বাদশ খ-, পৃ. ৫৮১)।
পরিশেষে, লাখো শহিদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, তাঁদের স্বপ্নমাখা ‘সোনার বাংলা’ গড়ার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে এবং সুখী, সমৃদ্ধ ও সুন্দর একটি বাংলাদেশ গড়ার ভবিষ্যত কারিগরদের আগাম অভিনন্দন জানিয়ে শেষ করছি।
লেখক: ড. আতিউর রহমান, গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।