Contact For add

Tue, May 28 2024 - 6:57:47 PM +06 প্রচ্ছদ >> স্বাস্থ্য

স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন এখন একটি গুরুত্বপূর্ন জনদাবীস্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন এখন একটি গুরুত্বপূর্ন জনদাবী

স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন এখন একটি গুরুত্বপূর্ন জনদাবী

স্বাধীনতার পর থেকে ৫৩ বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। স্বাস্থ্যসেবা খাতে নানা প্রতিষ্ঠান ও পরিধি বৃদ্ধি পেলেও আইন, নীতিমালার সংস্কার ও উন্নয়ন সে অনুসারে হয়নি। আইনের দূর্বলতার কারণে মানসম্মত আর মানহীনদের চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে চিকিৎসা ব্যবস্থার মানহীনদের ভোগান্তির দায় সকলকে বহন করতে হচ্ছে। আইনের সীমাবদ্ধতা, নজরদারির অভাব, স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরস (এসওপি/SOP) না থাকাসহ নানা কারণে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো মানুষের আস্থা হারাচ্ছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনটি প্রণয়নের কাজ দীর্ঘদিন ধরে চলমান থাকলেও এখনো সম্পন্ন করা যায়নি। এ আইনকে দুর্বল করতে স্বার্থান্বেষীরা সক্রিয় রয়েছে। সরকারকে সতর্কতার সাথে স্বাস্থ্য সেবার জন্য পুর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন করা জরুরি। ২৫ মে ২০২৪ জাতীয় প্রেসক্লাবে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-পবা ও বারসিক আয়োজিত সভায় এ আহবান জানানো হয়।

সভায় পবার নির্বাহী সভাপতি ডাঃ লেলিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এড. সৈয়দ মাহবুবুল আলম। সভায় বক্তব্য রাখেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরী, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী, আইনজীবী ব্যারিষ্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, প্রফেসর ডা. ফিরোজ খান সহ-সভাপতি, ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট, বারসিক এর পরিচালক ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক পাভেল পার্থ। সভা সঞ্চালনা করেন পবার সহ-সাধারণ সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ রাসেল।

প্রবন্ধে সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, জনস্বাস্থ্য, সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সাথে প্রায় ৪৫টি আইন জড়িত। তবে হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ The Medical Practice and Private Clinics and Laboratories (Regulation) Ordinance, 1982 আইনের আওতায় পরিচালিত হয়ে আসছিল, কিন্তু এখন এ আইনের কার্যকারিতা নেই।  এছাড়া ভোক্তা অধিকার আইন, দন্ডবিধিতে কতিপয় ধারায় স্বাস্থ্য সুরক্ষার কিছু বিধান রয়েছে। এ আইনগুলোর কোনটিই পুর্ণাঙ্গ নয় এবং বর্তমানে বাংলাদেশের বিশাল স্বাস্থ্য খাত ব্যবস্থাপনার জন্য পর্যাপ্ত নয়। আর এ বাস্তবতায় স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্য সেবা গ্রহীতার সুরক্ষা প্রদান এবং প্রতিষ্ঠানসমূহের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করবার লক্ষ্যে একটি যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করা জরুরি।

এতে আরো বলা হয়, প্রস্তাবিত আইনের শুরুতে ‘অপরাধী’ সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যা নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেয়। আইনের খসড়ায় ‘অবহেলা’ সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মেডিক্যাল নেগলিজ্যান্স/ চিকিৎসা অবহেলার বিষয়গুলো এ সংজ্ঞায় যুক্ত করা হয়নি। বরং, অবহেলা চিহ্নিত করতে হাসপাতাল/চিকিৎসা সহায়তা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব, চিকিৎসক, নার্স, চিকিৎসা সহায়তাকারী, উপকরণ সরবরাহকারী, রোগী, রোগীর এটেনডেন্টদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সুনির্দিষ্ট করা উচিত। অন্যথায় চিকিৎসা অবহেলার দায় শুধু চিকিৎসদের উপর বর্তাবে। পাবলিক হাসপাতাল, দাতব্য হাসপাতালের মতো গুরুত্বপুর্ণ প্রতিষ্ঠানকে আলাদা করে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। এতে পাবলিক হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা আইনি চ্যালেঞ্জের মাঝে পড়তে পারে। এছাড়া, টেলিমেডিসিন, ন্যানো টেকনোলজি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডিজিটাল, ডাটা সংরক্ষণ - ইত্যাদি বিষয়গুলো আইনে যুক্ত করা হয়নি।

বক্তারা খসড়া আইনে পাবলিক হাসপাতাল স্থাপন ও ব্যবস্থাপনার পৃথক সংজ্ঞা ও সুনির্দিষ্ট করার পাশাপাশি সরকার যাতে প্রয়োজনে পাবলিক হাসপাতালকে বিশেষ সুবিধা দিতে পারে তার ব্যবস্থা রাখা, রোগীর সুরক্ষায় ও চিকিৎসা অবহেলা নিরুপনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্যসেবায় খাদ্য, ঔষধ মালামাল, উপকরণ সরবরাহকারীর দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করা, চিকিৎসা ব্যয় কমাতে এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করতে রোগ নিয়ন্ত্রণ ও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা, চিকিৎসা ব্যয় কমাতে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম যুক্ত করা, স্বাস্থ্য সেবার মান ও যথার্থতা পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন, রেফারেল ইত্যাদি বিধান যুক্ত করা,  ডিজিটাল রেজিষ্টার ব্যবস্থার বিধান রাখা, জেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত অভিযোগ প্রদানে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কমিটি গঠন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক প্রশাসনিক জরিমানা প্রদানের ব্যবস্থা রাখা, পরিবেশ আদালত-ঔষধ আদালতের মতো স্বাস্থ্যসেবা আদালত গঠন এবং  সাধারণ নাগরিকদের সহজে অভিযোগ ও মামলা দায়ের করার ক্ষমতা প্রদান করার সুপারিশ করেন।

বিএমএ মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, চিকিৎসার ব্যর্থতার দায় নেয়ার পাশাপাশি আগামী দিনে সকল নাগরিকের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। আইনের উদ্দেশ্য শুধু এ খাতের মানুষকে সাজা প্রদান নয়, বরং স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত সকলকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সঠিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে।

ব্যারিষ্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, প্রস্তাবিত আইনে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়গুলো আরো সুনির্দিষ্ট হওয়া জরুরি। আইনটি পাস হলে বাস্তবায়নের বিষয় চলে আসবে। আইনে যদি বাস্তবায়নের বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে না থাকে তাহলে বাস্তবায়নে দুর্বলতা তৈরি হতে পারে। সেজন্য আইন বাস্তবায়নে সকলকে যেন দায়বদ্ধ করা যায়, খসড়া আইনে প্রশাসনিক জরিমানার পাশাপাশি সকল নাগরিকের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য একটি বিশেষ আদালত গঠন করা যেতে পারে।

পাভেল পার্থ বলেন, সর্বশেষ জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে স্বাস্থ্যখাতের উপর বিরূপ প্রভাবকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের ফলে স্বাস্থ্যের প্রভাব মোকাবেলায় বিশেষ অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে। জলবায়ুর পরিবর্তন খাদ্য উৎপাদন ও জনস্বাস্থ্যসহ মানুষের জীবনযাপনের উপর প্রভাব ফেলছে। এ সংক্রান্ত বিষয়গুলো খসড়া আইনে যুক্ত করা যেতে পারে।

ডক্টরস ফর হেলথ এন্ড এনভায়রনমেন্ট এর অধ্যাপক ডা. ফিরোজ আহমেদ খান বলেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা বলতে চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ও গ্রহণকারী – দুটো পক্ষকে বুঝাবে। কিন্তু খসড়া আইনে উভয় পক্ষকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। বর্তমানে চিকিৎসকদের কর্মক্ষেত্র সুরক্ষিত নয়। অবহেলাজনিত কারণে ক্রিমিনাল কেস দাখিল করা হচ্ছে এবং অবহেলা বা অপরাধ প্রমাণের আগেই চিকিৎসকদের হাতকড়া পরানো হচ্ছে। পৃথিবীর কোন দেশে অবহেলা ক্রিমিনাল কেস হিসাবে গণ্য হয় না।

মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে বারসিকের নগর গবেষক ও সমন্বয়কারী মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নগরের নিম্ন আয়ের মানুষেরা জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য প্রাকৃতিক কারণে বাধ্য হয়ে গ্রাম থেকে শহরের বস্তিতে এসে বসবাস করছে। গবেষণায় দেখা গেছে তাদের আয়ের প্রায় ৩০% ভাগ টাকা চিকিৎসার জন্য খরচ হয়। তার উপর মেডিসিনের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য চিকিৎসা নিয়ে টিকে থাকা অসম্ভব।  জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই মানুষেরা প্রতিনিয়ত নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে দিন দিন আরো প্রান্তিক হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনে নগরের নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে পবার নির্বাহী সভাপতি ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্যসেবার সাথে চারটি পক্ষ যুক্ত। প্রথমে সরকার,  সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন করা। সে আইনের অধীনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্যসেবার মান সমুন্নত রাখা ও বিকাশের লক্ষ্যে কাজ করে যাবে। সরকার প্রণীত আইন দ্বারা তদারকি কর্তৃপক্ষের অধিকার,দায়িত্ব এবং দায়বদ্ধতা সুনির্দিষ্ট করা।  দ্বিতীয়ত, হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সেবা গ্রহীতা হিসাবে যারা আসেন, তাদের অধিকার ও দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করা। তৃতীয়ত, সেবাদাতা ও তাঁর দলের প্রতিটি সদস্যের দায়িত্ব ও অধিকার সঠিকভাবে নির্দিষ্ট করা। একইসঙ্গে,  সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ও অধিকার নির্দিষ্ট করা। সর্বশেষ, স্বাস্থ্যসেবার উপকরণ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর এজাতীয় উপযুক্ততার মানদণ্ড নির্ধারণ, তাদের দায়িত্ব ও অধিকারের জায়গাটি সুপরিষ্কার করতে হবে।

সভাপতি আরো বলেন, সমন্বিত একটি স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রনয়ন করা গুরুত্বপূর্ণ একটি জনদাবি। এ আইনে যেন সবার অধিকার রক্ষা করা হয়, একইসঙ্গে অধিকার লঙ্ঘনকারী ও দায়িত্ব অবহেলাকারীকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করার সুযোগ থাকে।



Comments

Place for Advertizement
Add