দুর্ভেদ্য জঙ্গল। কাঁটাঝোপ আর লতাগুল্মের ছড়াছড়ি। জঙ্গলের পাশ কেটে বয়ে গেছে একটি লিকলিকে ঝিরি। ঝিরি ধরেই জলপ্রপাতের জল গড়িয়ে মিশে যায় হাকালুকি হাওরে। পড়ন্ত বিকালে ঝিরি-জঙ্গলের সন্ধিক্ষণে শানবাঁধানো পথ ধরে হাঁটলে শোনা যায় পোকামাকড়ের ‘ক্রির.. ক্রির..’ আওয়াজ। সুনসান নীরবতার মধ্যে সেই আওয়াজ তীক্ষ্ণভাবে কানে পৌঁছায়। ছড়ার ওপর উঁচু উঁচু গাছ-গাছালির সমাহার।
বড় বড় ডালপালার বিস্তার ঘটিয়ে জঙ্গলটাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলেছে প্রকৃতির এ বোবা সন্তানেরা। পথ ধরে সামনে এগোলেই নজরে পড়বে কাক্সিক্ষত সেই ঝরনাধারা। নাম ‘মাধবকুন্ড জলপ্রপাত’। যুগের পর যুগ ধরে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে পর্যটকদের মোহিত করছে জলপ্রপাতটি। বলা হয় দেশের বৃহত্তম ঝরনাধারার মধ্যে এটি অন্যতম। উচ্চতা ১৬২ ফুটের কাছাকাছি। নয়নাভিরাম মনোমুগ্ধকর এই জলপ্রপাতের অবস্থান মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার পাথারিয়া পাহাড়ে।
পাহাড়টি সম্পূর্ণ পাথরের সৃষ্টি। নামকরণেও সে রকম ইঙ্গিত মেলে। এই পাহাড় থেকেই সৃষ্টি হয়েছে আবার দুটি ছড়া। ওপরের অংশ ‘গঙ্গামারা ছড়া’, নিচের অংশ ‘মাধবছড়া’ নামে পরিচিত। মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের উৎপত্তি গঙ্গামারা ছড়া থেকে। পাহাড়ের ওপর থেকে পাথরের গা বেয়ে ছুটে আসা জলস্রোত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে হঠাৎ খাড়াভাবে উঁচু পাহাড় থেকে নিচে পড়ে দুটি জলধারার সৃষ্টি করেছে।
বর্ষা মৌসুমে জলধারা দুটি মিশে একত্রে নিমজ্জিত হয় প্রাকৃতিক কুন্ডে। এই কুন্ডের চারপাশ পাথরের পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত। এর মধ্যখানে অনবরত জলস্রোত নিমজ্জিত হওয়ায় ডানপাশে পাথরের গায়ে সৃষ্টি হয়েছে একটি বড়সড় গুহার। দেখতে অনেকটা চালাঘরের মতো। গুহাটি বিপজ্জনক বিধায় সেখানে সতর্ক নোটিসও টাঙানো হয়েছে। ইতিপূর্বে কিছু মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটায় কর্তৃপক্ষ বাড়তি সতর্কতার ব্যবস্থা নিয়েছে।
মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের পশ্চিমে অদূরে আরেকটি জলপ্রপাত রয়েছে। নাম ‘পরিকুন্ড জলপ্রপাত’। পরিকুন্ডের কাছেই চা-বাগানঘেরা দৃষ্টিনন্দন পরিবেশে খাসিয়া সম্প্রদায়ের বসবাস। তবে খাসিয়াপল্লীতে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ। মজার বিষয় হচ্ছে, মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের চারপাশঘেরা বিশাল বনভূমিকে কেন্দ্র করে স্থাপন করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ‘মাধবকুন্ড ইকোপার্ক’। ফলে বাড়তি আনন্দ পেয়ে থাকেন পর্যটকরা।
এ ছাড়া জলপ্রপাত-সংলগ্ন একটি শিবমন্দির রয়েছে। চৈত্র মাসের ত্রয়োদশী তিথিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বারুণীস্নানের পাশাপাশি মেলাও বসে এখানে। সে সময় বহু তীর্থযাত্রীর সমাগম ঘটে। এ ছাড়া বছরের যে কোনো সময় মাধবকুন্ডে পর্যটকদের যাতায়াত থাকে। এই জলপ্রপাতের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে বছরে লাখো পর্যটকের সমাগম ঘটে। ফলে সরকার প্রচুর রাজস্বও পেয়ে থাকে মাধবকুন্ড জলপ্রপাতকে কেন্দ্র করে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক লেখক