বাংলাদেশের যেকোন বড় শহরের রাস্তা দিয়ে যদি কেউ হাটে তবে প্রায় প্রত্যেকটি ফ্ল্যাট বাড়ির সামনে অতিথির গাড়ি বাহিরে রাখুন এরকম নোটিশ দেখতে পাবে। দৃষ্টিনন্দন এইসব ফ্ল্যাট বাড়ির সবচেয়ে দৃষ্টিকটু বিষয় হল বাড়ির সামনে গেটে ঝুলানো ‘অতিথির গাড়ি বাহিরে রাখুন’ রাখুন শীর্ষক নোটিশ বোর্ডগুলি। বাঙ্গালি সারা বিশ্বে অতিথিপরায়ণ জাতি হিসেবে পরিচিত, এই সব নোটিশ বোর্ডগুলি আমাদের চিরায়ত অতিথিপরায়ণতার সাথে যায় না।এই সব নোটিশ বোর্ড লাগানো হয়, কারণ অধিকাংশ ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি করার সময় অতিথিদের গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রাখা হয় নাই। এই জন্য যারা গাড়ি নিয়ে আত্মীয়, বন্ধু, পরিচিতদের ফ্ল্যাটে বেড়াতে যায় তাদেরকে বাধ্য হয়ে রাস্তায় গাড়ি পার্কিং করতে হয়, এটা বেশিরভাগ মেট্রোপলিটন শহরে যানযটের অন্যতম কারণ। এছাড়া যারা নিজের গাড়ি নিজেরা ড্রাইভ করে তাদের গাড়ি রাস্তায় পার্কিং করার জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকে।এইতো গেল ফ্ল্যাট বাড়ির গেটের সামনে ঝুলানো নোটিশ বোর্ডের কথা, বেশিরভাগ ফ্ল্যাট বাড়ির মধ্যে অতিথিদের রাত্রে থাকার জন্য বাড়তি কামরা থাকে না।তাই যারা বেড়াতে যায় তারা যাওয়ার সময়ই না থাকার মনোভাব নিয়ে বেড়াতে যায়। অতিথিদের আপ্যায়ন করার সময় গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রী অতিথিদের রাত্রিযাপন করার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারেন না।
এভাবে আমাদের ফ্ল্যাট সংস্কৃতি বাঙালির অতিথিপরায়ণতাকে সচেতন-অচেতনভাবে নিরুৎসাহিত করছে। শহরের অধিকাংশ ফ্ল্যাট ডিজাইন করার সময় কেবল পিতামাতা ও সন্তান নিয়ে গঠিত নিউক্লিয়ার পরিবার হিসাব করা হয়। অধিকাংশ ফ্ল্যাট বাড়ি, বিশেষ করে মধ্যবিত্তদের জন্য তৈরিকৃত ফ্ল্যাট, এমনভাবে তৈরি করা হয় যেখানে স্বামী- স্ত্রী এবং তাদের সন্তানরা থাকার পর বাড়তি কামরা থাকে না। এই জন্য আপনা-আপনি আমাদের যৌথ বা একান্নবর্তী পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে।আমাদের চিরায়িত পরিবার যেখানে মা-বাবা, ভাই-বোন, চাচা-চাচি, দাদা-দাদী, ফুফু সবাই থাকে তা আর কার্যত নেই।যদিও যৌথ পরিবার ব্যবস্থা আধুনিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাসহ নানা কারণে ভেঙ্গে পড়চে, এই লেখায় শুধুমাত্র যৌথ পরিবার ব্যবস্থায় ফ্ল্যাট সংস্কৃতির প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হবে।
পরিবার একটি সর্বজনীন সামাজিক প্রতিষ্ঠান। মৌলিকত্বের দিক থেকে অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় পরিবারের পৃথক স্বত্বা ও মর্যাদা রয়েছে।সমাজ বিজ্ঞানিরা মনে করেন, পরিবারের কোন বিকল্প নেই। পরিবার এমন কতিপয় কাজ এমনভাবে সম্পন্ন করেন, যা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে করা সম্ভব নয়। পরিবার হল মানুষের আত্মিক বন্ধনের সূতিকাগার ও প্রথম বিদ্যাপীঠ। যৌথ পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে, মানুষের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা বাড়ছে, সম্পর্কের বন্ধন শিথিল হচ্ছে, পারিবারিক অনুশাসনের ধরণ বদলাচ্ছে। মানুষের মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ গড়ে উঠছে। পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে মানুষের মধ্যে একাকীত্ব, হতাশা, নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে। একক পরিবারে কর্মজীবী বাবা-মায়ের ব্যস্ততার কারণে একক পরিবারের শিশুদের নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। এছাড়া একক পরিবারে বেড়ে উঠা শিশুদের সামাজিক দক্ষতার ঘাটতি থাকে, কমিউনিটি ফিলিং ও দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার প্রবণতার অভাব থাকে।
যৌথ পরিবার ভেঙ্গে আশির দশক থেকে গড়ে উঠা একক পরিবারগুলো এখন ভাল নেই। বিশেষ করে যেসব একক পরিবারগুলোতে স্বামী-স্ত্রী দুজনই কর্মজীবী, সেসব পরিবারে বেড়ে শিশুদের দেখাশুনা করার জন্য কেউ থাকে না। এসব শিশু নিরাপত্তাহীনতা, একাকীত্ব, এবং বিষণ্ণতায় ভুগে। এই জন্য এখন এই ধরণের পরিবারে সংসার দেখাশুনার জন্য বৃদ্ধ বাবা-মা বা অন্যান্য নিকট আত্মীয়দের বাসায় এনে রাখার প্রবণতা বাড়ছে। কিন্তু যেসব ফ্ল্যাট শুধুমাত্র একক পরিবারকে মাথায় রেখে করা হয়েছে, সেখানে চাইলেও মা-বাবা বা অন্য আত্মীয় স্বজনকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
সামান্য ভুল বোঝাবুঝি থেকেও শহরে বসবাসকারী একক পরিবারগুলোর সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। পারিবারিক দূরত্ববোধের কারণে এসব পরিবারে অভিভাবকদের হস্তক্ষেপ করার সুযোগ কম। পারিবারিক কাউন্সেলিং এর অভাবে সংসারে সব সময় ঝামেলা লেগে থাকে, যা অনেকক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদে রূপ নেয়।
আমাদের দেশে শহরগুলোর কোনটাই পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেনি।এসব শহরগুলোর কোনটাতেই আমাদের স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। অপরিকল্পিত এই শহরগুলোর ফ্ল্যাটবাড়িগুলো আরও বেশি অপরিকল্পিত। মানুষের জীবন-জীবিকার জন্য শহরে এসে বাস করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শহরে তারা যাতে তাদের পুরো পরিবার নিয়ে থাকতে পারে তার ব্যবস্থা থাকা উচিত। বর্তমানে ঢাকা ও অন্যান্য শহরে তিন অথবা চার বেডরুমসহ সুপরিসর আয়তনের ফ্ল্যাটগুলোর মূল্য অধিকাংশ শহরবাসীদের হাতের নাগালের বাইরে। এসব সুপরিসর আয়তনের ফ্ল্যাটগুলোর ভাড়াও বেশিরভাগ শহরবাসী বহন করতে পারে না। এই জন্য শহরে এই ধরণের সুপরিসর ফ্ল্যাটের চাহিদা কম।
ফলশ্রুতিতে রিয়েল এস্টেট বা ডেভেলপার কোম্পানিগুলো একক ফ্যামিলির জন্য উপযোগী স্বল্প পরিসরের ফ্ল্যাট বানাতে আগ্রহী। রিয়েল এস্টেট বা ডেভেলপার কোম্পানিগুলোর মালিকেরা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন জমির অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যের জন্য ফ্ল্যাটের দাম দাম বেশি হয়। তারা বলেন সরকার যদি জমির মূল্যে ভর্তুকি দেয়, তাহলে তারা স্বল্প মূল্যে জনগণের জন্য ফ্ল্যাট বানাতে পারেন। অপরিসর ফ্ল্যাট সংস্কৃতির জন্য উদ্ভূত মানুষিক স্বাস্থ্য ও আইন-শৃঙ্খলা জনিত সমস্যাসহ বিভিন্ন সমস্যার জন্য পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যে পরিমাণ মূল্য দিতে হয়, তার থেকে ভর্তুকিবাবদ খরচ করে জমির মূল্য কমালে এসব সমস্যার অনেকটাই আপনা-আপনি কমে যাবে।
এছাড়াও সরকার গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন করে এবং গ্রামেই কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে মানুষের শহরমুখিতা কমাতে পারে। ঢাকা শহরসহ বিভিন্ন শহরকে সচল রাখার জন্য মেট্রোরেল, ফ্লাইওভারসহ বিভিন্ন বড় বড় প্রকল্পে যে পরিমাণ ব্যয় করছে তার থেকে কম খরচে গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটিয়ে মানুষের শহরমুখি প্রবণতা রোধ করা সম্ভব।
বিশ্ববিখ্যাত লেখক জে কে রাউলিং পরিবার সম্পর্কে বলেছেন, “পরিবার হলো- জীবনের ঝড়ো সমুদ্রের একটি লাইফজকেট”। সুতরাং দেশের জনগণ যাতে পরিবারের সাথে একসাথে থাকতে পারে এই জন্য সরকারকে সর্বোচ্চ নীতি সহায়তা দিতে হবে।
শাহনেওয়াজ, আইনজীবী ও নাগরিক অধিকারকর্মী, ই-মেইলঃ newazuaplaw@gmail.com। সৈয়দ মাহবুবুল আলম, আইনজীবী, স্বাস্থ্য ও নীতি বিশেষজ্ঞ, ই-মেইলঃ syedmahbubul@gmail.com।