Holy Times Report:
'দূরের দিগন্ত’ মূলত পশ্চিমা সাহিত্যের যুগান্তকারী লেখাগুলো নিয়ে আলোচনা। কিন্তু সাহিত্য তো কোনো সীমানায় আবদ্ধ নয়। অনেক সময় এক লেখার সাথে আরেক লেখা সমান্তরাল হয়ে যায় বিষয় ও প্রকরণে। জীবিত অবস্থায় ভি.এস. নাইপল ও শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, কেউ কাউকে দেখেননি; কিন্তু তাদের প্রধান দুটি রচনা যথাক্রমে—‘এ হাউস ফর মি. বিশ্বাস’ ও ‘কুবেরের বিষয় আশয়’। দুই উপন্যাসেই সাব-অল্টার্ন চরিত্র নিজস্ব সত্তা, অস্তিত্ত্ব ও মানস প্রকাশে ব্যস্ত। বাড়ি নির্মাণের রূপকে মানুষের আশ্রয়হীনতা, আত্মনুসন্ধান ও পরিচয় বিনির্মাণ প্রচেষ্টার অন্তঃসারহীনতাকেই এই দুই উপন্যাসে তুলে ধরেছেন দুই ভিন্ন গোলার্ধের দুই সাহিত্যিক।
‘এ হাউস ফর মি. বিশ্বাস’ নাইপলের নিজ শেকড়হীন জীবনের ছায়া অবলম্বনে লেখা। টাইম ম্যাগাজিনের জরিপে এই উপন্যাস গত একশ বছরের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর একটি—কেন্দ্রীয় চরিত্র মোহন বিশ্বাসে নাইপলের পিতা শিরি প্রসাদ নাইপলের সমস্যাসংকুল জীবনের ছায়া দৃশ্যমান। পিতৃ-মাতৃহীন দরিদ্র মোহন বিশ্বাস সারাজীবনের ব্যর্থতা, আশ্রয়হীন ও অনিকেত জীবনে এক দৃঢ় প্রতিবাদ করেছিলো একটি নিজের বাড়ি তৈরী করে। কিন্তু তার জীবনে কোনো বাড়ি স্থায়ী হয়নি। একটির পর একটি অবলম্বন তাসের ঘরের মতো গুড়িয়ে যায়। জীবনের পরাজিত নায়ক নাকি প্রমিথিউসের উচ্চতা কোনটা তার জন্য সঠিক অভিধা? আত্মীয়-স্বজন তাকে পাগল বলে। তবুও মোহন বিশ্বাস পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাওয়ার জন্য এক আত্মপরিচয়হীন মানুষের প্রাণান্ত লড়াইয়ের প্রতীক।
মি. বিশ্বাস দুঃস্থ একটি পরিবার থেকে উঠে এসে আশ্রিত হয়ে ঘরজামাই হলেন তুলসী পরিবারের হনুমান হাউসে। স্ত্রীর নাম শ্যামা। কিন্তু এক মিনিটের জন্য শান্তি পেলেন না। কারণ এই পরাশ্রয়ী জীবনের গ্লানি তাকে কুরে কুরে খায়। এই পরজীবী জীবনের গ্লানি থেকে বাঁচতে তিনি ব্যবসা করলেন, ছোট চাকুরী নিলেন এবং শেষে সাংবাদিকতা শুরু করলেন। কিন্তু সব জায়গায় তিনি ব্যর্থ। অবশেষে ছেলে ‘আনন্দ’-এর মাধ্যমে নিজের সফলতা খুঁজে পেতে চাইলেন। আনন্দ বৃত্তি পেয়ে ইংল্যান্ডে পড়তে যায়; কিন্তু এই বিচ্ছেদ তার কাছে অসহ্য লাগে। স্বাধীনচেতা মোহন বিশ্বাস হনুমান হাউসের বন্দিশালা থেকে আলাদা হওয়ার জন্য এক বাড়ি কিনলেন। কিন্তু সেই বাড়ির কিস্তি পরিশোধের আগেই অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন। তুলসী পরিবারের (ঔপনিবেশিক বিশ্বের প্রতীক) দুর্গের সাথে মি. বিশ্বাসের ব্যক্তিগত লড়াই অস্তিত্বের স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিত্বের সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। হয়তো শেষ পর্যন্ত সে ব্যর্থ, কিন্তু তার সংগ্রাম তাকে ট্রাজিক হিরোর স্থানে বসিয়েছে।
নাইপলের ‘এ হাউস ফর মি. বিশ্বাস’-এর তুলনায় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ অনেকটা অপরিচিত। এটাও একধরণের সাহিত্যিক সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবের ফসল; ইংরেজি ভাষায় না লিখলে কেন্দ্রের থেকে অনেক দূরে পেরিফেরি বা প্রান্তিকে থাকতে হয়। কিন্তু গভীর পর্যবেক্ষণে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের শক্তিমত্তা চোখ এড়াবে না। ‘কুবেরের বিষয় আশয়’উপন্যাস প্রান্তিক থেকে উঠে আসা এক কেন্দ্রীয় চরিত্রের বিত্তবান গৃহমালিক হওয়ার কাহিনী। সে বাড়ির সামনে একটি বাড়ি, একটি বাগান, পুকুরের জন্য এবং পুকুরে মাছ ধরার স্বপ্ন দেখে। কলকাতা থেকে রোজ ট্রেনের থার্ড ক্লাসে চেপে কুবের সাধু খাঁ সস্তায় জমি কেনার জন্য কদমপুরে যায়। এই জমি কেনার গল্প একসময় পরাবাস্তব মানসিক জেদে অস্তিত্ত্ববাদী সংগ্রামের প্রতীকে পরিণত হয়—যেন কুবের জমি নয়, নিজের পরিচয় কিনছে।
‘কুবেরের বিষয় আশয়’-একুবেরের চরিত্রের মাধ্যমে শেকড়হীন মানুষের বৈষয়িক মানসিকতার একটি সূক্ষ্ম বিবরণ পাওয়া যায়। কুবের যখন পানির হারে জমির দাম শোনে সে খুব দুঃখবোধ করে।সে আফসোস করে, আহা যদি আরো আগে জন্ম নিতো সে তবে আরো সস্তায় জমি কিনতে পারতো। সে বাড়ি করবেই।
তার মা বলে, বড় দুঃখ ছিল আমাদের কারো একখানা নিজের ঘর নেই—একটু যে বসবো একাএকা থাকবো তার উপায় নেই—তুই একটা ভালো বসার ঘর করিস।
কুবের মনের আনন্দে জমি কেনে কারণখারাপ সময়ে বিষয় থাকলে আশ্রয়ের চিন্তা থাকে না। বিষয় মানুষকে দেখে, আশ্রয় দেয়।তারপরও কুবের নিরাশ্রয়ী।পুরো উপন্যাসে বারবার ফিরে আসে জমি, ঘর, সাফ-কবলা, জমি রেজিস্ট্রি ইত্যাদি প্রসঙ্গ। কিন্তু কোথাও কুবের স্বস্তি পায়না। উপন্যাসের শেষে বাবা দেবেন্দ্রলাল সাধু খাঁ ছেলের বাসায় বেড়াতে এসে কুবেরকে তার ছটফট স্বভাব পাল্টে একটু ধীর হতে বলে।
কীসের দুঃখ কুবেরের? ম্যাজিক-মাস্টার কাম ভণ্ড গুরু ব্রজফকির, তার তিন নম্বর স্ত্রী আভা, স্কুল ফ্রেন্ড সনৎ কেউই সুখী নয় এই ভুবনে। সকলেই পায়ের তলায় মাটি চায়। বাবু হরিরাম সাধু খাঁর বংশধর কুবের শান্তি খোঁজার জন্য আভাকে জাপটে ধরে, সনৎ-এর সাথে নিষিদ্ধ পাড়ায় যায়, জমির পর জমি কেনে,আভাকে নিয়ে পালিয়ে সুন্দরবনের নিজ দ্বীপে যায়। স্ত্রী বুলুকে দিয়ে গেছে সাধুখাঁ নগর। বহরিডাঙ্গা সাবরেজিস্ট্রি অফিসে কুবের জমির দলিলে সই করে। কুবের তার মৃত মায়ের কথা ভাবে; সে দেখতে পায় তার মা বাস-স্টেশনে তল্পিতল্পা নিয়ে বসে আছে।
শান্তি মেলে না। সারাজীবন বাড়ি ও জমি করতে করতে ‘ড্রিম মার্চেন্ট’ কুবের নিজেই যে কখন গৃহহীন উদ্বাস্তু হয়ে গেছে তা নিজেই জানে না। স্ত্রী বুলুকে সে বলে:
আমি কোনোদিকে তাকাইনিবুলু। আরো কত নিরাপদে রাখা যায়তোমাদের, শুধু তাই দেখে গেছি—আসলে এতো করেও, ভালো করে দ্যাখো—আমার মাথার ওপরেও কোন শেড নেই!
কুবেরের এই স্বীকোরোক্তিই প্রমাণ করে তার গৃহ নির্মাণ কতটা ঠুনকো। উপন্যাসের শেষ পরিচ্ছেদে যেন জাদু বাস্তবতার ছোঁয়া; কুবের জমি-জমা, ঘর-বাড়ি সব ছেড়ে এক মই বেয়ে চাঁদ ধরতে উঠে পড়ে—‘মইয়ের প্রায় শেষ কাঠিতে পা রেখে কুবের চাঁদ পেয়ে গেল। মাথার ওপরে হাওয়ায় ঝুপসি তাল পাতাসুদ্ধ কাঁটা তোলা ডালগুলো নড়ছে। নীচে তাকালেই মাঠভর্তি ধান, আধখানা দীঘি জুড়ে পদ্ম ফুটে আছে—সারি দিয়ে দাঁড়ানো পরীদের যে কেউ এক্ষুনি উড়ে যেতে পারে—‘পুরো কদমপুর কিনে ফেলেও কুবের যেন বাস্তুহারা; সে শৈশবে মায়ের কাছেই ফিরে যাচ্ছে।
ভি.এস. নাইপলের উপন্যাসের শেষেও মোহন বিশ্বাস তেমনি এক হতাশা নিয়ে বাস্তুহারা। উপন্যাসের শেষে আমরা শুনি মোহন বিশ্বাসের শেষকৃত্যের পরে বোনেরা চলে গেলো যার যার বাসায় আর শ্যামা ও তার সন্তানেরা ‘went back in the Prefect to the empty house’। শূন্য বাড়িতে ফিরে যায় বিশ্বাসের সন্তানেরা। ছেলে আনন্দ দূরে ইংল্যান্ডে বসে বাবার মৃত্যুর খবর শোনে। উপন্যাসের শুরুতেও শুনি মি. বিশ্বাস দুটি বাড়ি কিনলেও একটাতেও শান্তি পাননি। পিতৃ-মাতৃহীন বিশ্বাস তবুও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত খালি বাড়ি বাড়ি করে গেলেন, কারণ—এটা ছাড়া জীবন কী ভয়ঙ্কর না হত, এই তুলসীদের দয়ার ওপর বেঁচে থাকা। কী ভয়ঙ্কর হতো এইভাবে বাঁচা-মরা, নিজের মাথার ওপরে একটুকরো ছাদ নেই। আর পায়ের তলায় মাটিও নেই। নাইপল ‘unncessary and unaccomodated’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে পৃথিবীর তাবৎ উত্তর-ঔপনিবেশিক-উন্মূল মানুষের অসহায় অবস্থা প্রকাশ করেছেন; নাইপল বোঝাতে চেয়েছেন একটা বাড়ি—ভালো হোক, মন্দ হোক, একটা বাড়ি দরকার ছিল মি. বিশ্বাসের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য। তা না হলেজীবন ফালতু হত। দুটি উপন্যাসেই উত্তর ঔপনিবেশিক উদ্বাস্তু মানসিকতার সংকটের পরিচয় মেলে। তুলসিদের যৌথ পরিবারের কয়েদখানা থেকে নাইপল বিশ্বাসকে বের করে এনেছেন এবং একইভাবে শ্যামল দেবেন্দ্র লাল সাধু খাঁর পরিবার থেকে কুবেরকে বের করে এনে একটি ‘ব্যক্তিগত কুবের’ বানিয়েছেন।
ত্রিনিদাদে ভারতীয়দের বিচ্ছিন্নতা এবং স্থানচ্যুতি বুঝি মি. বিশ্বাসের পরিণতি দেখে। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৩ সালে এবং পশ্চিমবঙ্গে চলে যান দেশ বিভাগের পর।
ভারতীয় বন্ডেড দাস পরিবারে জন্ম নেয়া নাইপল, না ঘরকা, না ঘাটকা। না পারছেন ত্রিনিদাদের ক্রেওল সমাজকে আপন ভাবতে; না পারছেন ভারতে ফিরে যেতে। ১৯৬১ সালে জগৎবিখ্যাত উপন্যাস ‘এ হাউস ফর মি. বিশ্বাস’ও ১৯৬৩ সালে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাস যদি নাইপলের ‘এ হাউস ফর মি. বিশ্বাস’-এর পাশাপাশি পড়া হয় তবে উত্তর ঔপনিবেশিক সময়ের উদ্বাস্তু সত্তার অস্তিত্বগত সমস্যার মিল চোখে না পড়ে যাবে না।
বিশ্বাস এবং কুবেরের সংগ্রাম একইভাবে পাঠক হৃদয়কে স্পর্শ করে। তারা উভয়েই সেই সাব-অল্টার্ন বা নিম্ন-বর্গের মানুষ যারা কোনোমতে একটি পরিচয় চায় মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য। দুজনেই অসুখী, অতৃপ্ত কিন্তু জীবন সংগ্রামী। ঘর তারা বানাতে চেয়েছিল বাস করবে বলে নয়, বরং নিজেদের অস্তিত্বকে, স্বকীয়তাকে জানান দিতে। বাঁচতে তারা পারেনি—বিশ্বাস ও কুবের সাধু খাঁ তবুও শূন্য ঘরের নির্মাতা হিসেবে ট্রাজিক নায়ক। হাসন রাজার সেই গানের কথা মনে পড়ে: ‘লোকে বলে, বলে রে, ঘর বাড়ি ভালা না আমার / কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাঝার’। #