হলি টাইমস রিপোর্ট :
গত ৩০ সেপ্টেম্বর বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে জাঁকজমক আয়োজনে মিস ওয়ার্ল্ড পাওয়া পিরোজপুরের মেয়ে ফেরদৌস ঐশি তবে আলোচনায় বিজয়ীর চেয়েও এগিয়ে দুজন। তারা হলেন লাবণী ও অনন্যা। এ আয়োজনে সেরা দশজনকে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল বিচারকের। এর মধ্যে আফরিন সুলতানা লাবণীকে বিচারক সাদিয়া ইবনাজ ইমি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তাকে যদি তিনটি উইশ করতে বলা হয়, সে উইশগুলো কি হবে এবং কাকে উইশ করতে চান’? এমন প্রশ্নে লাবণী জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সি-বিচ কক্সবাজার, সুন্দরবন এবং পাহাড়-পর্বতকে তিনি উইশ করতে চান।
এমন উত্তরে বিচারকমণ্ডলী ও দর্শক মহলসহ সারাদেশের মানুষ এ বিষয়টিকে বেশ হাস্যকরভাবে নিয়েছে। বিষয়টি বর্তমানে সারাদেশে ভাইরাল হয়ে যায়। যে যার মতো করে ট্রল করছে, নানা কটূক্তি করছে।
এ বিষয়ে লাবণী মুখ খুলেছেন। তিনি বলেন, “আমাকে যখন বিচারক প্রশ্ন করলেন তখন আমি যে কি বলেছি তা আমি নিজেও জানি না। তখন আমি কেমন সিচুয়েশন পার করছিলাম সেটা শুধু আমি জানি। আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে চতুর্থ বর্ষে পড়ছি।
একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ‘উইশ’র মানে জানবে না এটাও সবার বিশ্বাস করতে হয়! উইশের মানে সবাই জানে, আমিও জানি। কিন্তু আমি বিচারকের প্রশ্নে তাদের মতো করে কিংবা দর্শকদের মতো করে উত্তরটা দিতে পারিনি। এজন্য আমি এখন সবার কাছে হাসির পাত্র হয়ে গেছি। যে যার মতো করে কথা বলছে, কমেন্ট করছে, ট্রল করছে। এতে আমার মানসিক অবস্থাটা কেমন হয় সেটা কেউ ভাবছে না।”
নাবিলা সেই সময় নিজের মানসিক অবস্থার কথা জানাতে গিয়ে বললেন এক করুণ গল্পের কথা। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারে আমার বাবা-মা আমি আর দুই বড় বোন। দুই বোনেরই বিয়ে হয়ে গেছে।
বাবা রাজবাড়ীতে ব্যবসা করেন। আমি শুধু মাকে নিয়ে ঢাকায় থাকি। ১১ মাস ধরে মা আমার সাথে ঢাকায়। আমার মায়ের দুটা কিডনিই পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। যার জন্য আমার মায়ের শারীরিক অবস্থা প্রতিনিয়ত খারাপের দিকে যাচ্ছে।
প্রতিদিন চারবার করে ডায়ালাইসিস করতে হতো। প্রথম দিকে চিকিৎসকরা করলেও পরে সেটা শিখে আমি নিজেই করতাম। কিছুদিন আগে খুব খারাপ অবস্থা হলে আম্মুকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করি। সবকিছু আমার একাই করতে হতো। মাকে এভাবে রেখেই আমি গ্রুমিং ক্লাস করতে যেতাম।
সবসময় যেতে একটু দেরি হতো, কারণ আমার মাকে দেখার কেউ নেই। বাবা যদি মায়ের কাছে চলে আসেন তাহলে চিকিৎসার জন্য টাকার ব্যবস্থা করবেন কীভাবে? এসব মানসিক অবস্থা নিয়েই নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি। একটা প্লাটফর্ম চেয়েছিলাম নিজের জন্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘যখন মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ ২০১৮ এর ফাইনাল অনুষ্ঠিত হবে সেদিন ৯টার মধ্যে কনভেনশন সেন্টারে থাকার কথা ছিল। আমার সেখানে পৌঁছায়ও দেরি হয়। আম্মুর অবস্থা সেদিন খুবই খারাপ ছিল।
আমি আসার কিছুক্ষণ পর হাসপাতাল থেকে নার্স ফোন দিয়ে জানালো আমার মা মারা গেছে! এ খবর শুনে আমি চোখে সরষে ফুল দেখছিলাম। একদিকে স্বপ্ন পূরণের এত কাছে দাঁড়িয়ে আছি। অন্যদিকে মায়ের মৃত্যুর খবর। কী করবো আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।’
এ অবস্থায় আমার মানসিক অবস্হা কেমন ছিল সেটা শুধু আমি জানি। এ কথা আমি কাউকে জানাইনি। এখানে স্টেজে মোবাইল আনাও নিষেধ ছিল। আমি স্টেজের পেছনে পিলারের কাছে লুকিয়ে রেখেছিলাম। সেখানেই নার্সের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। আমার অবস্থা যখন ভয়াবহ তখনই আবার ফোন আসে।
আমি জানতে পারলাম আমার আম্মুর পাশের বেডের একজন মারা গেছে, আম্মু নয়। হাসপাতালে আমি নেই আম্মু একা তাই আরও ভয় পাচ্ছিলেন খুব। আর এ কারণে সেদিন আম্মুর অবস্থা আরও বেশি খারাপ হয়ে গিয়েছিল। নার্স আমাকে মেসেজ দিয়ে জানালো যে, তাকে এখনই আইসিওতে নিতে হবে না হলে খুব বিপদ হবে।
আমার ভেতর যে কি কাজ করছিল তা বোঝানোর মতো নয়। আমি বললাম, আইসিওতে নিয়ে যান আমি একটু পরই আসছি। আমার দেহটা স্টেজে থাকলেও আমার মন পড়েছিল মায়ের কাছে। চাইছিলাম রেজাল্ট যা কিছু হোক এটা যেন দ্রুত শেষ হয়। কারণ আমার সমস্যার জন্য তো আর অনুষ্ঠান আটকে রাখা যাবে না।
এসবের মধ্যে হাসতে হাসতে পারফর্ম করেছি। বিচারকদের প্রশ্নের জবাব খুঁজেছি। স্টেজের পেছনে যাওয়ার সুযোগ পেলেই খোঁজ নিতাম। এর মধ্যে বিচারকের প্রশ্নে কি উত্তর দিয়েছি আমি নিজেও তা জানি না। মানুষ কোনো দিন আমার সেদিনের অবস্থা বুঝবে না। তারা কেবল এটাই বুঝতে পেরেছে একটা মেয়ে সেরা সুন্দরী হতে চায় কিন্তু উইশ করার মানে জানে না।
লাবণী আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘গ্রান্ড ফিনালের একদিন পরই আমার মা মারা যায়। আমার মায়ের কথাগুলো এখনো কানে বাজে।’ লাবণী বলেন, ‘এখন অনেকেই বলতে পারেন যে, মাকে এমন অবস্থায় রেখে আমি কেন অংশগ্রহণ করলাম মিস ওয়ার্ল্ডে। এটা আমার মায়ের স্বপ্ন ছিল। আমার কাছে আমার মা-ই আমার পৃথিবী।
আমাকে ভীষণ ভালোবাসতো। আমি সাইক্লিং, বাইক রাইডিং, সাঁতার সবই পারি! ব্ল্যাকবেল্টও ছিলাম মার্শাল আর্টে। আমার মা আমাকে বলতো একদিন আমি অনেক বড় হবো। আমি যেন স্বপ্নগুলোকে পূরণ করি।
আরও বলতো তিনি তো বেশিদিন থাকবেন না, আমি যেন তার স্বপ্নপূরণে পিছপা না হই। মিস ওয়ার্ল্ডে যখন সিলেক্ট হই তখন মা আমাকে আরও বেশি সাপোর্ট দিতেন। ফাইনালের দিনই মায়ের সাথে আমার শেষ কথা হয়। এরপর আর কথা বলেননি। ২ অক্টোবর দুপুরে আম্মু মারা যান। এরপর আম্মুর লাশ রাজবাড়ীতে নিয়ে এসে দাফন করেছি।’
মিস ওয়ার্ল্ড বিজয়ী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার কোনো আক্ষেপ নেই। আসরের প্রথম দিকে আমি এগিয়ে ছিলাম। আমার মধ্যে সব কোয়ালিটিই ছিল। চারটা রাউন্ড পার করে ফাইনালে এসেছি। এরপর যে কি হলো তা আর জানি না। কপালে ছিল না হয়তো।’