Contact For add

Sun, Dec 22 2024 - 7:03:43 AM +06

ভয়াবহ দুর্যোগে বাংলাদেশের গণতন্ত্র

ভয়াবহ দুর্যোগে বাংলাদেশের গণতন্ত্র

অধ্যাপক ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশের প্রথিতযশা সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং গ্রিন ইউনিভার্সিটির সাবেক ভিসি। শিক্ষকতা করছেন ৪০ বছরেরও বেশি সময়। সরকারের রাষ্ট্রদূত, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য ছাড়াও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা। এখন বাংলাদেশ ইসলামী ইউনিভার্সিটির ভিসির দায়িত্বে আছেন। বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির পর্যালোচনা নিয়ে লিখেছেন ১৯টি গ্রন্থ। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে ১০০টির বেশি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

নব্বই দশকে প্রতিষ্ঠিত সংসদীয় গণতন্ত্র আজ দিকভ্রান্ত। ক্রমেই মহাদুর্যোগের দিকে ধাবিত হচ্ছে। শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতালিপ্সা সংঘাতকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। বাড়িয়ে দিচ্ছে রাজনৈতিক সংকট। জাতির মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট। হলিটাইম্‌স ডটকমের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনায় সমাজবিজ্ঞানী ও রাজনীতির বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী এমন নানা সংকটের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের পাশাপাশি উত্তরণেরও কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। ১৬ মার্চ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন লুৎফুল সাদিক।

হলিটাইম্‌স ডটকম: বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যত সম্পর্কে আপনার অভিমত 

অধ্যাপক আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী: সংসদীয় গণতন্ত্র হচ্ছে আধুনিক যুগে একটি দেশের জন্য সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা। বাংলাদেশ অনেক ত্যাগ-তিতীক্ষার মাধ্যমে ১৯৯১ সালে সংসদীয় ব্যবস্থার সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু নানা কারণে সেই সংসদীয় গণতন্ত্র আজ দিকভ্রান্ত। বিশেষ করে শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে যখন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিবর্জিত হয় তখন সংসদীয় গণতন্ত্র রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। সুতরাং বলা যায় সংসদীয় গণতন্ত্র ভয়াবহ এক দুর্যোগের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

হলিটাইম্‌স ডটকম: বর্তমানের অস্থিতিশীলতা কি শুধুই রাজনৈতিক?

আনোয়ারউল্লাহ: বাংলাদেশে চলমান অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা এখন বহুমুখী সংকটে রূপ লাভ করেছে। এক সংকট থেকে আরেক সংকটে পড়েছি আমরা। রাজনৈতিক সংকট দিয়ে শুরু হলেও এ সংকট এখন সর্বগ্রাসী হয়েছে। এই রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টির পেছনে মূলত দায়ী শাসক দল। তাদের ক্ষমতালিপ্সা ও ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রবণতার কারণে এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সরকার সব গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পরিহার করেছে। নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে ক্ষমতা করায়ত্ত্ব করাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। এর ফলে রাজনৈতিক হানাহানি বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনীতিতে ধস নেমে এসেছে, যা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।

হলিটাইম্‌স ডটকম: চলমান অস্থিরতায় নাগরিকদের মধ্যকার বিভাজনের প্রভাব কি হতে পারে?

আনোয়ারউল্লাহ: চলমান বিভাজন জাতির জন্য সর্বনাশ ডেকে আনবে। একটি বিভক্ত জাতি কখনও সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে না। এর সর্বগ্রাসী প্রভাব সমাজের সর্বক্ষেত্রে দেখা যাবে। সমাজে ও রাষ্ট্রে এই বিভাজন সৃষ্টি করে স্বার্থান্বেষী মহল ফায়দা লুটার চেষ্টা চালায়। একটি দেশের মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হওয়া মানে ওই রাষ্ট্রের ভিতকে দুর্বল করে দেয়া। আর রাষ্ট্রের ভিত দুর্বল হয়ে গেলে রাষ্ট্রটাও অকার্যকর হয়ে পড়ে। সুতরাং চলমান বিভাজন আমাদের জন্য অশনি সংকেত। জাতীয় ঐক্য ও সংহতির মাধ্যমে এই সংকট মোকাবেলা করা দরকার।

হলিটাইম্‌স ডটকম: বাংলাদেশের রাজনীতির অসহনীয় একটি দিক হচ্ছে— রাজনৈতিক ভিন্নমত এক সময় রাজনৈতিক সংঘাতে রূপ পায়। সামাজিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর কারণ কি?

আনোয়ারউল্লাহ: বাঙালি একটি জাতিগোষ্ঠী হিসেবে অসহনশীল জাতি। এই জাতির ইতিহাসে নিজেরা বেশিরভাগ সময়ই শাসিত হয়েছে। যদিও ঔপনিবেশিক শাসন থেকে আমরা মুক্ত তারপরও শোষণ বঞ্চনার সেই হীনমন্যতা এখনো আমাদের মননে বিরাজ করছে। ভিন্ন মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার প্রবণতা অর্জন করার যে মানসিকতা তা এখনো সৃষ্টি হয়নি। আর ক্ষমতার সব কাঠামোতে কিছু রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিতা প্রতিষ্ঠা হওয়ায় ভিন্নমত সহজে সংঘাতের দিকে চলে যাচ্ছে। আধুনিক যুগের গণতান্ত্রিক সময়ে এসে ভিন্নমতের প্রতি যদি আমরা শ্রদ্ধাশীল না হই, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে লালন না করি তাহলে এ জাতির কপালে দুঃসহ পরিণতি ডেকে আনবে।

হলিটাইম্‌স ডটকম: এসবের পরিণতি বা সমাপ্তি কিভাবে হতে পারে বলে আপনি মনে করেন-

আনোয়ারউল্লাহ: চলমান অস্থিতিশীলতার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। চলমান পরিস্থিতির একটু খেয়াল বুঝা যায় সামনে আরও দুর্দিন অপেক্ষা করছে। সরকারি দল ও বিরোধী দল সবাই জিরো টলারেন্সে। একইসঙ্গে শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত নিরসনের কোনো চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। ভায়োলেন্স আরও বেশি ভায়োলেন্স জন্ম দেয়। এরপর সৃষ্টি হয় নৈরাজ্য। সহিংসতা, নৈরাজ্য ও অর্থনৈতিক মন্দা একটি দেশকে ভয়ংকর পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। এই সংকটের মাধ্যমে আবার স্বৈরশাসন বা সামরিক শাসন বা দেশ স্থায়ী সংঘাতে চলে যেতে পারে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নষ্ট হলে দেশে অস্থিতিশীলতা বেড়েই চলবে। তাই চলমান অস্থিতিশীলতা বন্ধে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বহাল রাখার বিকল্প নেই।

হলিটাইম্‌স ডটকম: স্বাধীনতার ৪২ বছরে বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন, তা কতটুকু ইতিবাচক?

আনোয়ারউল্লাহ: বাংলাদেশ যে উদ্দেশে ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয়েছিল সে আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। আমরা চেয়েছিলাম একটি সমৃদ্ধ ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে। যেখানে স্বৈরশাসন থাকবে না, থাকবে না নিপীড়ন-নির্যাতন, শোষণ ও বঞ্চনা। আজ ৪২ বছরে যদি আমরা হিসাব-নিকাশে বসি তাহলে দেখতে পাব সবকিছুই অপূর্ণ রয়ে গেছে। তবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক সফলতা অর্জিত হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি। একজন আশাবাদী মানুষ হিসেবে আমি মনে করি, স্বাধীনতার স্বপ্ন একদিন পূরণ হবে।

হলিটাইম্‌স ডটকম: ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ নিয়ে কথিত প্রগতিশীলদের দাবি সম্পর্কে আপনার মত কি?

আনোয়ারউল্লাহ: পৃথিবীর অনেক দেশে এখনো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল আছে। আর বংলাদেশের মত একটি মুসলিম দেশে ধর্মভিত্তিক দল থাকবে এটাই স্বাভাবিক। একইসঙ্গে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেব ধর্মের স্বাধীনতা থাকবে এটাও স্বাভাবিক। সবাই স্ব স্ব ধর্ম পালন করবে। কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া যাবে না। আমাদের সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। সংবিধান অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে— এটাই কাম্য।

হলিটাইম্‌স ডটকম: স্থিতিশীল রাজনীতির জন্য ও চলমান সংঘাতের সমাধানের পথ কি?

আনোয়ারউল্লাহ: সরকারি দল, বিরোধী দলসহ সব রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনায় বসে উপর্যুক্ত করণীয় ঠিক করতে হবে। সরকার ও বিরোধী দলগুলোকে সংঘাতের পথ পরিহার করতে হবে। জনমানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতি সরকারকে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। নির্যাতন-নিপীড়নসহ হত্যা-গুম-খুন বন্ধ করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা সরকারের এই মুহূর্তে প্রধান কর্তব্য।

হলিটাইম্‌স ডটকম: আগামী সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের বিষয়ে যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে তাতে সরকারের কি পদক্ষেপ নেয়া উচিত?

আনোয়ারউল্লাহ: সরকারের উচিত বিরোধী দলগুলোর মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজন করা। আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হবে এ বিশ্বাস বিরোধী দলগুলোর মধ্যে সৃষ্টি হওয়ার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। শুধুমাত্র সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে বর্তমান সংকট কাটিয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব।

হলিটাইম্‌স ডটকম: আমাদেরকে মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আনোয়ারউল্লাহ: হলিটাইম্‌স ডটকম এবং আপনাকেও ধন্যবাদ।


Place for Advertizement
Add