Mon, Apr 21 2025 - 7:26:39 PM +06

নৌমন্ত্রনালয়ের দুই সচিবের বিরুদ্ধে কেনো দুর্নীতিতে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ উঠলো


News Image
হলি টাইমস রিপোর্ট :
হঠাৎ করেই নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দুইজন  সচিবের বিরুদ্ধে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করার অভিযোগ উঠেছে কেনো। চাকরি বিধিমালা লঙ্ঘন ও শৃঙ্খলা ভঙ্গে সহায়তা করতে কেনোইবা তারা কর্মকর্তাদের উৎসাহ  দেবেন  এমন প্রশ্ন উঠেছে। 
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছেন যে, নৌপরিবহন অধিদফতরের ব্যাপক আলোচিত ও সমালোচিত ইজিএইএমএনএস প্রকল্পটি শুরু থেকেই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অধীনে চলে যায়। ৭৭৯ কোটি টাকার এই প্রকল্পের পরতে পরতে দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতির মামলা হয়েছে দুদকে। 
সাবেক সচিব মোস্তফা কামালের প্রত্যক্ষ মদদে এই প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি করেছেন সাবেক প্রকল্প পরিচালক নাজমুল হক। দুদকের মামলায় জেলে যেতে হয়েছে তাকে। তারপরই প্রকল্প পরিচালক ক্যাপ্টেন আবু সাইদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমান মোস্তফা কামালের প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন। ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর দেলোয়ার রহমান অনুকম্পা পান অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) দেলোয়ারা বেগম এবং যুগ্ম সচিব সৈয়দ আলী আহসানের । একগাদা দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্বেও নৌপরিবহন অধিদফতর এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কোনো উর্ধতন কর্মকর্তাই দেলোয়ারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই গ্রহন করতে পারেনি। কিন্তু এতে ওই দুই  সচিবের কতটা হাত রয়েছে। অথবা আদৌ তারা দেলোয়ার রহমানকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন কি না  সেই প্রশ্নটি সামনে এসেছে। 
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ওই সূত্রটি জানিয়েছেন, দেলোয়ার রহমানের বিরুদ্ধে অনেকগুলো অভিযোগ মন্ত্রনালয়ে এবং দুদকে জমা রয়েছে। তদন্ত চলমান থাকার মধ্যেই দেলোয়ার রহমানকে প্রকল্প পরিচালকে পদ থেকে সরিয়ে পাবনা মেরিটাইম একাডেমিতে পদায়ন করা হয়। গত ১০ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে পাবনায় বদলি করা হলেও তিনি সেখানে যোগদান করেননি। 
সরকারি সার্ভিস রুল অনুযায়ি [সার্কুলার নং ইডি/এস এ -১-৭৪/৮৩-২৫/৩০০ তারিখ: ৬/৬/৮৩ইং] যদি স্থানান্তরের প্রয়োজন না হয় তাহলে ৭ দিন আর স্থানান্তরের প্রয়োজন হলে ১৪ দিনের মধ্যে পদায়নকৃত কর্মস্থলে অবশ্যই যোগদান করতে হবে। উপরোক্ত নিদের্শের ব্যতিক্রম ঘটিলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে সরকারি আইন ও সংশ্লিষ্ট বিধি অনুসারে চাকুরীচ্যূতিসহ যে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।  এছাড়াও অন্য একটি সার্কুলারে [সম/উনি-১/৫৭/৮৬-১৮(১০০) তারিখ: ১৩/০১/৮৭ইং] বলা হয়েছে যে বদলির স্থলে যোগদান না করলে অসদাচরন হিসেবে গণ্য হবে। ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, বদলি স্থলে যোগদান না করে কালক্ষেপন করা বদলি বাতিলের জন্য তদবির করা, বিশেষ স্থানে যাওয়ার জন্য তদবির করা অসদাচরন বলে গণ্য হবে এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার আওতায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনেও তা সন্নিবেশিত করা হবে।
ওই সূত্রগুলো বলেছেন, সাবেক প্রকল্প পরিচালক দেলোয়ার রহমান বদলির এসব রুলস ভঙ্গ করেছেন। বদলি করার তিন মাসেও তিনি পাবনা মেরিটাইমে যোগদান করেননি। বিষয়টি নৌপরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক একাধিকবার চিঠি দিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব(প্রশাসন)বরাবরে জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। বদলি স্থানে যোগদান না করে উল্টো দেলোয়ার রহমান নৌপরিবহন অধিদফতরে ঘনঘন যাতায়াত করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছেন। তার বন্ধু নটিক্যাল সার্ভেয়ার ও পরীক্ষক ক্যাপ্টেন কাজী মুহাম্মদ আহসানের  রুমে ষড়যন্ত্রমূলক রুদ্ধদার বৈঠক করেছেন। শৃঙ্খলাভঙ্গের এই বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার অবিহত করা হয়েছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়নি নৌমন্ত্রণালয়। 
বদলির তিন মাস অতিবাহিত হওয়ার পর মি. দেলোয়ার পদায়নকৃত স্থানে যোগদান না করায় পাবনা মেরিটাইম একাডেমি এবং নৌপরিবহন অধিদফতর উভয় প্রতিষ্ঠানেই একধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। মি. দেলোয়ারের বেতন বন্ধের নোটিশও দেওয়া হয়। তারপরও তিনি যোগদান করেননি।
এদিকে নৌপরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক দাপ্তরিক কাজে বিদেশে থাকার মধ্যেই দেলোয়ারের পাবনা বদলির আদেশ বাতিল করে ৬ এপ্রিল চিঠি দেয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ) দেলোয়ারা বেগমের  নির্দেশনায় নিয়ম ভেঙে বিষ্ময়কর এই চিঠি দিয়েছে মন্ত্রণালয় ।যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয় তখনই। 
হলি টাইমসের এই প্রতিবেদক জানতে পেরেছেন যে, নৌপরিবহন মন্ত্রনালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন’কে মিথ্যা কথা বলে এই বদলি বাতিলের চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। নৌ উপদেষ্টাকে কোনো একজন যুগ্ম সচিব বলেছেন যে, নৌপরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালকের অনুরোধ এবং সম্মতিতে বদলির চিঠি বাতিলের পরিপত্র জারি করা হচ্ছে। যার ফলে নৌ উপদেষ্টা এতে সম্মতি দিয়েছেন।কিন্তু বাস্তবে কোনো যুগ্ম সচিবই মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলেননি। এমনকি এতে তিনি সম্মতিও প্রদান করেননি ।প্রশ্ন উঠেছে কোন যুগ্ম সচিব অথবা কোন উর্ধতন কর্মকর্তা দেলোয়ারের মতো একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার জন্য উপদেষ্টার কাছে  মিথ্যা কথা বলেছে বা শৃঙ্খলা বিরোধী কাজ করেছে। নৌ উপদেষ্টা বিষয়টি বুঝতে পেরেই ৬ এপ্রিল ইস্যু করা পরিপত্রটি সঙ্গে সঙ্গে বাতিলের নির্দেশ দেন। ৭ এপ্রিল পরিপত্রটি বাতিল করে মি. দেলোয়ারকে পাবনা মেরিটাইম একাডেমিতে  যোগদান করতে বাধ্য করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রনালয়। এছাড়াও ১০ এপ্রিল তারিখে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ওই প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগে যে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে তার বেশ কিছু অকাট্য তথ্য প্রমান দুদকের চেয়ারম্যানকে পরিপত্রের মাধ্যমে প্রদান করে দেলোয়ারের বিরুদ্ধে প্রয়োজন ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।
নৌপরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক এ প্রতিবেদক’কে বলেছেন, তিনি অনেকটাই হতবাক। যে দেলোয়ারের বিরুদ্ধে বদলির কর্মক্ষেত্রে যোগদান না করায় বেতন বন্ধের চিঠি দিয়েছে মন্ত্রণালয় । তার বদলির আদেশ কি ভাবে বাতিল হয়। বদলির আদেশ বাতিল করতে হলে তো আগে বেতন ভাতা বন্ধের আদেশের চিঠি বাতিল করতে হবে। আর তিনি যে সম্মতি দিয়েছেন এটা একেবারেই মিথ্যা ছিলো। তার সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের  কেউ-ই যোগাযোগ করেননি।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনেকেই বলেছেন যে, মি. দেলোয়ারের সঙ্গে যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন)সৈয়দ আলী আহসানের ভালো সম্পর্ক। এছাড়াও অতিরিক্ত সচিব ( প্রশাসন) দেলোয়ারা বেগমের দফতরে তাকে অনেকবারই দেখা গেছে। এই দুই সচিব যে দেলোয়ারকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন তার তথ্যগত কোনো প্রমান নেই হলি টাইমসের কাছে। তবে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন যে, যদি এই দুই সচিবের সঙ্গে মি. দেলোয়ারের সুসম্পর্ক না-ই’বা থাকে তাহলে তারা কেনো তাকে এতো শৃঙ্খলাভঙ্গের সুযোগ দিলেন। 
যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) সৈয়দ আলী আহসান এ প্রতিবেদক’কে বলেছেন, দেলোয়ারের সঙ্গে তার কোনো কাজ-ই নেই তো ভালো সম্পর্ক হবে কি ভাবে। তার সঙ্গে কাজ হচ্ছে প্রশাসনের। তিনি বলেছেন, মি. দেলোয়ারের পুরো বিষয়টি দেখার দায়িত্ব হচ্ছে অতিরিক্ত সচিব-প্রশাসনেরই ।তিনিই দেলোয়ারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) দেলোয়ারা বেগমের সঙ্গে মুঠো ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে । তিনি ফোন রিসিভ না করায় কোনো মন্তব্য প্রকাশ করা গেল না।  
যুগ্ম সচিব সৈয়দ আলী আহসান এক সময় শেখ হাসিনার মেয়ে পুতুলের শ্বশুর মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের পিএস ছিলেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে পারিবারিক গন্ডগোলের কারনে মোশাররফ হোসেনকে মন্ত্রীত্ব-নেতৃত্ব সবই হারাতে হয়েছে। মন্ত্রী থাকাকালীন মোশাররফের সীমাহীন দুর্নীতির সাক্ষী ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান। খন্দকার মোশাররফের পিএস থাকার কারনে সৈয়দ আলী আহসানকেও শেখ হাসিনার রোষানলে পড়তে হয়েছে। সরকারি সুযোগ সুবিধা ও পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়েছে।কিন্তু ৫ আগস্টের পর সৌভাগ্য ভর করছে তার ওপর। তিনি এখন পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সচিব হিসেবে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে রয়েছেন।   
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন,  নৌপরিবহন অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক নেজামুল হক সেই সময়ে একটি অভ্যন্তরীন তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছিলেন। তদন্ত কমিটি এই প্রকল্পে কমপক্ষে ১২০ কোটি টাকার দুর্নীতির সন্ধান পান। সেই তদন্ত প্রতিবেদন অদৃশ্য কারনে আলোর মুখ দেখেনি। বর্তমান মহাপরিচালকও দেলোয়ারের নানা দুর্নীতির বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছেন। প্রকল্পটির শেষ হলেও এখনো দুর্নীতির রেশ রয়েছে সবখানে।