হলি টাইমস রিপোর্ট :
ছোট্ট শিশুদের ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন বড় মনের মানুষ হওয়ার জন্য লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল যে কাব স্কাউটের সূচনা করেছিলেন সারা বিশ্বে তা ২০১৯ সালে এসে পুরোপুরি কলঙ্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ স্কাউটস। এই শিশুদের জন্য বাদযন্ত্র কেনার নামে কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা লুটপাট করার অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ স্কাউটের বিরুদ্ধে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানিয়েছেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাব স্কাউটস সম্প্রসাণ প্রকল্প-৪র্থ পর্যায় গ্রহণ করে। তবে মন্ত্রণালয় এই দায়িত্ব অর্পন করে বাংলাদেশ স্কাউটস’কে। বাংলাদেশ স্কাউটসের পরিচালক রুহুল আমীন’কে এই প্রকল্পের পরিচালক করা হয়। বর্ধিত প্রকল্পের মোট বাজেট ধরা হয় ৪০৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ বাজেট ব্যয় নির্ধারন করা হয় অবকাঠামো নির্মান খাতে এবং ৪৫ শতাংশ প্রশিক্ষণ খাতে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছেন, এই প্রকল্পের শুরু থেকেই প্রকল্প পরিচালক অর্থ লোপাটের একটি সুপরিকল্পিত নীল নকশা তৈরি করেন। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব বা ডিপিপি’তে নেই এমন বেশি কিছু বিষয় বা কাজ নিজেই অন্তর্ভূক্ত করেন। যেখান থেকে লুটে নেন প্রায় ১০ কোটি টাকা।
হলি টাইমসের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রকল্পের টাকায় দেশের বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রদানের জন্য ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে ৩০৩০ (তিন হাজার ত্রিশ)সেট বাদ্যযন্ত্র বা ড্রাম সেট এবং ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে ৯০৯০ (নয় হাজার নব্বই) সেট বাদ্যযন্ত্র বা ড্রাম সেট ক্রয় করা হয়েছে।কিন্তু বাস্তবে ওই পরিমান ড্রাম সেট ক্রয় এবং বিতরন করার কোন তথ্য প্রমান পাওয়া যায়নি। অথচ প্রতিসেট বাদ্যযন্ত্র ৫ হাজার ৫’শত টাকা দরে মোট ১২ হাজার ১২০ সেট বাদ্যযন্ত্র ক্রয়ে খরচ দেখানো হয়েছে ৬ কোটি ৬৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা।যার পুরোটাই লোপাট বা চুরি করা হয়েছে। ধারনা করা হচ্ছে কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে ডিপিপি’তে নেই এমনসব কাযর্ক্রম দেখিয়ে।
হলি টাইমসের এই প্রতিবেদক জানতে পেরেছেন যে, দেশের কয়েকটি স্কুলের কাব স্কাউটকে ড্রামসেট সরবরাহ করা হয়েছে। তবে তার কোনো তালিকা নেই।
এলিফ্যান্ট রোডের মেলোডি এ্যান্ড কোং নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে এই ১২ হাজার ১২০ সেট বাদ্যযতন্ত্র কেনা হয়েছে। বাস্তবে এসবের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
বাদ্যযন্ত্র কেনার ভূয়া বা জাল বিল ভাউচার তৈরি করে প্রকল্প পরিচালক রুহল আমীন পুরো টাকাটাই লোপাট করেছে।
ড্রামসেট ক্রয় সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই প্রাথমিক ও গনশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে।
স্কাউটদের জন্য প্রচলিত ড্রাম বাদ্যযন্ত্র : ছবি -সংগৃহিত
প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির সভাপতি সচিব গোলাম হাসিবুল আলমের দফতর থেকে উপসচিব মোহাম্মদ নাজমুল হক এ প্রতিবেদক’কে জানিয়েছেন, প্রকল্প পরিচালক রুহুল আমীন সারা দেশের কাব স্কাউটের জন্য যে ১২ হাজার ১২০ সেট বাদ্যযন্ত্র ক্রয় করেছেন গত দুই বছরে তার কোনো অগ্রগতি প্রতিবেদন মন্ত্রনালয়ে জমা দেননি। দেশের কোথায় কোথায় কোন কোন স্কুলে কাব স্কাউটের ড্রাম সেট দেওয়া হয়েছে তার বিন্দুমাত্র কোনো তালিকা নেই। এমনকি কোন কোম্পানি থেকে ড্রাম সেট কিনেছেন, তার গুণগত মান কি সেই বিষয়টিও জানে না মন্ত্রণালয়।
নির্বাহী পরিচালক উনু চিং
এদিকে বিষয়টি নিয়ে মুঠো ফোনে কথা বলা হয় বাংলাদেশ স্কাউটসের নির্বাহী পরিচালক মি. উনু চিং এর সঙ্গে। তিনি এ প্রতিবেদক’কে বলেন, ফোনে দুর্নীতির বিষয়ে আলাপ করা ঠিক হবে না। আপনি অফিসে আসুন সব তথ্য দেওয়া হবে। প্রতিবেদক মি. চিং এর অফিসে গেলে তিনি উল্টো সুরে কথা বলতে শুরু করেন। তিনি জানান, কাব স্কাউটের ড্রাম সেট কেনা বিষয়ে কোনো তথ্য তার কাছে নেই। আবার বলেন কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না।
হলি টাইমসের এই প্র্রতিবেদক তাকে বলেন, কোনো তথ্য দেওয়ার প্রয়োজন নেই । আপনি শুধু হ্যা এবং না বলেন যে, কাব এস্কাউটের জন্য ১২ হাজার ১২০ সেট বাদ্য যন্ত্র কেনা হয়েছে কি না ? উত্তরে মি. চিং বলেন, আমি বলবো না। পরে আবার বলেন ,আমি জানিনা। অবশেষে তিনি প্রতিবেদক’কে জানান, আপনি আইন অনুযায়ী তথ্য চেয়ে আবেদন করেন তাহলে আমি তথ্য দেবো। এ প্রতিবেদক উল্টো তাকে জানান , হলি টাইমসের কাছে তথ্য রয়েছে আপনি শুধু মন্তব্য করতে পারেন যে, ওই পরিমান ড্রাম সেট কেনার বিষয়টি আপনি জানেন অথবা জানেন না। । মি. চিং উত্তেজিত হয়ে বলেন, কত ড্রাম সেট কেনা হয়েছে তা তার জানা নেই। বিষয়টি প্রকল্প পরিচালক রুহুল আমীনই জানেন।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মি. রুহল আমীনের সঙ্গে কথা বলেছেন হলি টাইমসের এই প্রতিবেদক। মি. আমীন বলেছেন, কি পরিমান ড্রাম কেনা হয়েছে, প্রতিসেট কত টাকায় কেনা হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা এবং টাকার অঙ্ক তিনি বলতে পারবেন না। ফাইল দেখে বলতে হবে । মি. আমীন জানান, ডিপিপিতে ড্রাম কেনার বিষয়টি উল্লেখ আছে। তিনি উপজেলার শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে এই ড্রাম সেট বিতরন করেছেন। তবে কোন কোন উপজেলায় কতগুলো ড্রাম সেট পাঠিয়েছে তার কোনো পরিসংখ্যান তিনি বলতে পারবেন না। তবে তিনি এটা বলেছেন যে,কাগজে কলমে সব টাকার হিসাব এবং ড্রাম সেট প্রদানের তালিকা ঠিকঠাক করে লেখা আছে। নিয়ম মাফিক চাইলে আপনাকে সব তথ্য দেওয়া হবে।
সংশ্লিস্ট একটি সূত্র বলেছেন, মি. রুহুল আমীন বাস্তবেই এই সব কেনা কাটার হিসেব নিকেশ কাগজে কলমে তৈরি করে রেখেছেন। কোনো অডিট হলে কিংবা কিউ জানতে চাইলে সেটা দেখাতে পারবেন। তবে বাস্তবতা হলো ১২ হাজার ড্রাম সেটের মধ্যে ১২’শত ড্রাম সেটও কাব স্কাউটকে বিতরন করা হয়নি।এমনকি বিধি বহির্ভূতভাবে এই সব ড্রাম সেট বিতরনের দায়িত্ব দিয়েছে স্কাটউ সপ’কে। বিষয়টি মি.রুহুল আমীন স্বীকারও করেছেন। মি. আমীনের মতে তিনি যে কেনাকাটা করেছেন তা, নিয়ম মেনেই করেছেন।কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি করা হয়নি।
নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানিয়েছেন, ব্যাপক দুর্নীতির কারনেই প্রকল্পটি যথা সময়ে শেষ করা সম্ভব হয়নি। ২০১৯ সালে শুরু হয়ে প্রকল্পটি ২০২৩ সালেই শেষ হওয়ার কথা ছিল।তখন প্রকল্পের বাজেট ছিল ৩৫৫ কোটি ৪০ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। কিন্তু নানা অনিয়ম আর অদক্ষতার কারনে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সাল পযর্ন্ত বাড়ানো হয়েছে। বাজেট বেড়ে দাঁড়ায় ৪০৮ কোটি টাকা। একই সঙ্গে এই প্রকল্পের যে মূল উদ্দেশ্য তাও বাস্তবায়ন করতে পারেনি প্রকল্প পরিচালক।
সরকার এই প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে ৩০ হাজার ৭০০ টি প্রাথমিক স্কুলে কাব স্কাউট টিম গঠন করার উদ্যোগ নেয়। লক্ষ্য ছিল প্রখর বুদ্ধি এবং মানবিক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ৭ লাখ ৩৫ হাজার নতুন কাব স্কাউট বা নেকড়ে শিশু সৃষ্টি করার। যারা আগামী দিনে বাংলাদেশের সুনাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠবে। দেশের সেবায় নিয়োজিত হবে। কিন্তু প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতি হওয়ার কারনে সরকারের সেই প্রত্যাশা অপূরনই থেকে যাচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ স্কাউটের আন্তর্জাতিক কাযর্ক্রমে ব্যাপক আর্থিক অনিয়ম এবং মানব পাচারের বেশ কিছু তথ্য অনুসন্ধান করেছে হলি টাইমস। আগামীতে সেই সংম্পর্কিত প্রতিবেদন পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হবে।