Wed, Oct 16 2024 - 10:36:28 PM +06

তিন দিনে তিনবার লাগলো আগুন : ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনার আশঙ্কা নৌ পরিবহন অধিদফতরে


News Image
 
 
হলি টাইমস রিপোর্ট :
ভয়াবহ প্রাণঘাতি অগ্নি দুর্ঘটনার আশঙ্কা নৌ পরিবহন অধিদফতর ভবনে। মাত্র দিন দিনের ব্যবধানে তিনবার আগুন লেগেছে ভবনটিতে। চরম আতঙ্ক বিরাজ করেছে সেখানকার কর্মচারিদের মধ্যে। অনেকেই বলেছেন, এই ভবনে মূলত দুর্নীতির আগুন লেগেছে। ভবন নির্মানে ব্যাপক অনিয়ম, নিম্নমানের ফায়ার ফিটিংস সামগ্রি লাগানো এবং ফায়ার সেফটি যথাযথ না থাকায় মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ছে ভবনটিতে।  
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, বুধবার দুপুর ২টার দিকে চীপ নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দীনের অফিস রুমে হঠাৎই  আগুন লেগে যায়।আতঙ্কিত হয়ে পড়েন অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীরা। দ্রুততার সঙ্গে সার্কিট ব্রেকার অফ করে এবং ফায়ার ডিস্টিংগুইসার থেকে গ্যাস নির্গমন করে আগুন নেভানো হয়।তবে গত কয়েকদিনে বারবার আগুন লাগার কারনে চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন কর্মকর্তা কর্মচারীরা। অনেকেই মহাপরিচালককে জানিয়েছেন যে, তারা ফায়ার সেফটি নিশ্চিত না হয়ে অফিস করতে ভয় পাচ্ছেন। 
আগুন লাগার কিছুক্ষনের মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হন নৌ পরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম (ই) বিএসপি, এনইউপি, বিসিজিএম,বিসিজিএমএস, এনডিসি, পিএসসি, বিএন। তিনি ঘটনাস্থলে এসেই তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। বারবার আগুন লাগার পরও কেনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি তা জানতে চান দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা এস্টাব্লিশমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম অ্যান্ড ইন্ট্রিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেমের (ইজিআইএমএনএস)প্রকল্প পরিচালক ক্যাপ্টেম আবু সাইদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমান, ডেপুটি নটিক্যাল সার্ভেয়ার ফরহাদ জলিল বিপ্লব এবং প্রকল্পের সহকারি পরিচালক (অপারেশন) পতিত পবন দাশের কাছে। তবে তারা কেউই সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি। ওই সময় ইলেক্ট্রিক বিভাগের কর্মচারী এবং প্রকল্পের যারা ভবনে ইলেক্ট্রিক ওয়ারিংয়ের কাজ করেছেন তাদের দ্রুত ডাকা হয়। 
আগুন লাগার পর ঘটনাস্থলে ঠিকাদারদের ইলেক্ট্রিশিয়ানরা কাজ করছেন : ছবি - হলি টাইমস
 
 
 
ঘটনাস্থলেই প্রকাশ্যে আসে যে, যারা এই ভবনের ইলেক্ট্রিক ওয়ারিংয়ের কাজ করেছে তারা নিম্ন মানের লাইট, তার, সকেট, সার্কিট ব্যবহার করেছেন। ভবনের পুরো ইলেক্ট্রনিক কৌশলে বড় ধরনের গলদ রয়েছে। 
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বুধবার চীফ নটিক্যাল সার্ভেয়ারের অফিস রুমে একটি লাইটের সর্ট সার্কিট হয়ে আগুন লেগেছে।ওই লাইটের লোকাল নাম ফেন্সি লাইট। বাজারে খুবই কম দামে ওই লাইট কিনতে পাওয়া যায়। সেফটির জন্য যে সার্কিট সিস্টেম করা হয়েছে তাতেও গলদ। আগুন লাগলে অটোমেটিক সার্কিট নিচের দিকে পড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তিন দিনে তিনবার যে আগুন লেগেছে তাতে কিন্তু সার্কিট নিচে পড়েনি। এছাড়াও গত একমাস ভবনের ফায়ার এলার্ম নষ্ট থাকলেও তা সংশ্লিস্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা গোপন রেখেছেন । আজ বুধবার আগুন লাগার পর ফায়ার এলার্ম কেনো বাজেনি এই বিষয়টি বেশ জোরালোভাবেই কর্মচারীরা প্রশ্ন তোলেন। প্রকল্প কর্মকর্তা বিপ্লব এবং পতিত পবন দাশ জানান, ফায়ার এলার্মে কোনো সমস্যা নেই।  তবে উপস্থিত ইলেক্ট্রিশিয়ান স্পষ্টভাষায় বলে দেন যে গত একমাস আগে থেকেই ফায়ার এলার্ম নষ্ট। এতে তখনই কর্মচারীদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয় ।
 
চীপ নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দীন ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ফায়ার সেফটি নিয়ে ছেলেখেলা ঠিক না।তার প্রশ্ন, দুই চারজন কর্মচারি কর্মকর্তা আগুনে পুড়ে মরে যাওয়ার পর কি আপনারা এটা ঠিক করবেন। তিনি তার অফিস কক্ষের সঠিক অগ্নি নিরাপত্তা সনদ না দিলে এই অফিস কক্ষ ব্যবহার করতে আগ্রহী নয় বলেও জানিয়ে দেন। 
গত সোমবার এই ভবনের  সাত তলায় সার্ভার সিস্টেমে সকালের দিকে ভয়াবহ আগুন লাগে। তারপরের দিনই আগুন লাগে সাত তলার মেরিন কোর্টে ।আর বুধবার ৬ তলায় আগুন লাগলো। এই আগুন লাগা নিয়ে বেশ তাচ্ছিল্য আর তামাশা করেছেন প্রকল্পের ডেপুটি নটিক্যাল সার্ভেয়ার ফরহাদ জলিল বিপ্লব।তিনি এই ভবনে বারবার আগুন লাগার বিষয়টি তার ভাষায় ইঙ্গিত করে বলেছেন, আসলে আমি সব সময় ছোট খাটো অগ্নি দুর্ঘটনা পছন্দ করি। তাহলে বড় দুর্ঘটনার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা যাবে। এমনকি এই কর্মকর্তা মহাপরিচালক এবং চীফ নটিক্যাল সার্ভেয়ারের চান্দি গরম বলে ঠাট্টা মশকরা করেন। ছোট্ট বাচ্চার কলা কেনার আব্দার নিয়েও ইঙ্গিতপূর্ণ গল্প ফাঁদেন ।যা উর্ধতন কর্মকর্তাদের প্রতি চরম অবমাননাকর ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ ছিল। এছাড়াও তিনি জানান, এখন আর তাদের কিছু করার নেই, কারন, প্রজেক্ট হ্যাজবিন ক্লোজড।  
 
অন্যদিকে প্রকল্প পরিচালক দেলোয়ার রহমান বলেছেন, আগুন লাগায় ভয়ের কিছু নেই। ভবনের ইন্সুরেন্স করা আছে আর কোরিয়ান কোম্পানির কাছ থেকে দুই বছরের নিরাপত্তা গ্যারান্টি নেওয়া আছে। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। বিষয়টি আগুনের। আগুনের একটি স্ফুলিঙ্গ মুহুর্তে সব পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিতে পারে। এই ভবন আগুনে পুড়ে গেলে তারপর গ্যারান্টির টাকা দিয়ে কি হবে? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর তিনি দেননি। 
তবে তিনি সাত তলার সার্ভার স্টেশনে আগুন লাগার দায়  এড়াতে পারেন না বলে জানিয়েছেন । এও বলেছেন, সার্ভার স্টেশনে যে ইউপিএস লাগানো হয়েছে তা পুরানো, কেনো নতুন দেওয়া হলোনা । এর দায়ভার আমাদের কেনো নিতে হবে । এছাড়াও আগুন লাগলে কেনো সার্কিট ব্রেকার নিচে পড়বে না তা নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তিনি। শিগগিরই সংশ্লিস্ট ঠিকাদারদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন বলে জানিয়েছেন মি. দেলোয়ার রহমান। 
তিনি এ প্রতিবেদক’কে বলেছেন, সাত তলার সার্ভার আমার প্রকল্পের আওতায় নয়। পুরানো ইউপিএস আগের হেড অফিস থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। ডিজি স্যারকে জিজ্ঞেস করেন।  কিন্তু ইলেক্ট্রিক ওয়ারিংটা তার প্রকল্পের অধীনেই হয়েছে। যে কারনে তিনি দায় এড়াতে পারেন না। 
নৌ পরিবহন অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক কমডোর নিজামুল হক এই ফায়ার ফিটিং সিস্টেমের কাজ নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ ছিলেন। ব্যাপক অনিয়ম এবং দুর্নীতির বিষয়টি তিনিই প্রথম সামনে আনেন। তার সময়কালে এই কাজ চলমান থাকায় তিনি ভুল ফায়ার ফিটিং প্লান, দুই নম্বর ক্যাবল সংযোগ, নিম্নমানের ইলেক্ট্রিক সামগ্রির ব্যবহার বন্ধ করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন।কিন্তু বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,   এই ভবনের নকশা অনুমোদনের সময় রাজউকের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ফায়ার সার্ভিস ও ডিফেন্স অধিদপ্তরের যে ছাড়পত্র জমা দেয়া হয়েছিল তা ছিল জাল। ফায়ার সার্ভিস ও ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে নৌ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে জানানো হয়, এই ভবনের অনুকুলে তারা কোন ছাড়পত্র প্রদান করেনি। ভবনের বেজমেন্টে পাওয়ার সাব-স্টেশন ও জেনারেটর হাউজ পাশাপাশি স্থাপন করায় ভয়াবহ অগ্নিঝুঁকি সৃষ্টি করা হয়েছিল। এই ঝুঁকি এড়াতে পরবর্তীতে অতিরিক্ত প্রায় ৬ লাখ টাকা ব্যয় করে স্থাপনা দুটি আলাদা করা হয়েছে। এছাড়া ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি ঝুঁকি রোধক পাম্প বসানোর কথা ছিল, বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব  দেখা যাচ্ছে না। এই ভবনের পুরো ইলেক্ট্রিক ওয়ারিংয়ের বা ফায়ার ফিটিংসের তদারকির দায়িত্ব ছিল প্রকল্পের সহকারি পরিচালক (অপারেশন) পতিত পবন দাশের ওপর। যতো দুর্নীতি বা অনিয়ম হয়েছে তা এই কর্মকর্তার যোগসাযশে হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। 
গত ২০১৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন মাসের মধ্যে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের জন্য এই ১১ তলা ভবন নির্মানের কথা ছিল। কিন্তু নানা কারনে পরবর্তীতে সময়সীমা বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ৩০ জুন করা হয়। যা পরে আরো চার মাস পেছানো হয়েছে । ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই ভবনটি নির্মান করতে ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করছে। 
এদিকে অগ্নি নিরাপত্তায় কেনো ঝুঁকি তৈরি হলো, কি ধরনের   ইলেক্ট্রিক্যাল সামগ্রি ব্যবহার হয়েছে , কেনো বারবার আগুন লাগছে এবং  কি ধরনের অনিয়ম ফায়ার সেফটি কাজে হয়েছে সেই বিষয়টি একজন এক্সপার্ট নিয়োগ করে তদন্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন মহাপরিচালক। প্রয়োজনে তিনি ব্যক্তিগত অবস্থান থেকেই এই বিষয়টি তদন্ত করবেন। তিনি হলি টাইমস’কে বলেছেন, সবার আগে তার কর্মকর্তা কর্মচারীদের  নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবেন।