হলি টাইমস রিপোর্ট :
গুলি গ্রেনেড আর জ্বালাও পোড়াও মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার সারা বাংলাদেশে যে শাট ডাউন কর্মসূচি পালন করেছে সাধারন ছাত্ররা তাতে প্রাণ গেছে ১১ জনের। সব মিলিয়ে আহত হয়েছে কমপক্ষে সাড়ে তিনশ’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য দুই মন্ত্রীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টে কোটা সংক্রান্ত যে মামলা চলমান রয়েছে তার শুনানি এগিয়ে আনার জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলকে রোববারই আবেদন করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রীর দফতর। এদিকে মার্কিন পররাস্ট্র দফতর বাংলাদেশের উত্তাল ছাত্র আন্দোলনে যে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা এবং অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা পযর্বেক্ষন করা হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে।
এই ছাত্র আন্দোলন আর সাধারণ ছাত্রদের হাতে নেই । কয়েকটি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে চলে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।গত দুই দিনে ছাত্রদের হাতে দেশীয় অস্ত্র , লাঠিসোটা আর মারমুখী আচরনে বদলে গেছে কোটা বিরোধী আন্দোলন। সহিংস রুপ নিয়েছে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে কমপক্ষে দেড়শ পয়েন্টে আগুন দিয়েছে ছাত্ররা। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সেন্টার বিটিভি, পুলিশ বক্স, মেট্রোরেলের বক্স, সড়ক টোল প্লাজা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন ও সেতু ভবন।আগুন দেওয়া হয়েছে, গাড়ি, মোটর সাইকেলে।ভাংচুর করা হয়েছে দোকানপাট।
গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন তাতে তিনি এই আন্দোলনের প্রতি নৈতিক সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন, আদালতের রায় সন্তোষজনক হবে। তিনি আন্দোলন পরিহার করার জন্য ছাত্রদের প্রতি আহ্বান জানান। আজ বৃহস্পতিবার তিনি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক , শিক্ষা মন্ত্রী মহিবুল হাসান এবং অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনসহ বেশ কয়েকজনকে দায়িত্ব দিয়েছেন ছাত্রদের সঙ্গে বসে সমস্যার সমাধান করতে। কিন্তু ছাত্র আন্দোলনের যারা সমন্বয়ক তারা বলেছেন, রক্ত আর মৃত দেহের ওপর দিয়ে আমরা আলোচনায় বসতে পারিনা। তারা বলেছেন, সুনির্দিষ্ট দাবি দেবে তারা । তাদের সেই দাবি যদি সরকার মানে তাহলেই আলোচনায় বসবে ।
কোটা বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক শারজিস আলম, আরিফ সোহেল, নাহিদ, হাসানাত আব্দুল্লাহ এমন মন্তব্য করার পর রাত ৭ টা পযর্ন্ত কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিষয়টিতে সমাধানের কোনো আশা দেখা যায়নি।
এদিকে ছাত্ররা তাদের আন্দোলনে র্যাব পুলিশ বিজিবির পাশাপাশি সরকার দলীয় ছাত্র লীগের নিযাতনের প্রতিবাদ করেছে। তারা বলেছে সরকার পুলিশ দিয়ে ছাত্রদের আন্দোলন প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। পুলিশ র্যাব বিজিবি সোয়াট এবং ছাত্রলীগের আক্রমনে শুধু বৃহস্পতিবারে ৯ জন ছাত্র মারা গেছে বলে দাবি করেছে আন্দোলনকারীরা। তবে ত্রিমুখী এই সংঘর্ষে সারা দেশে আরো ২ জন সাধারণ মানুষ মারা গেছে বিভিন্ন স্থানে।
বৃহস্পতিবার যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে রয়েছে, মাদারীপুরের দিপ্ত দে, সাভার মিলিটারী ইনিস্টিটিউটের ছাত্র ইয়ামিন, আবতাব নগরে জিল্লুর শেখ, উত্তরায় ৫ জন মারা গেছে কিন্তু তাদের নাম ঠিকানা এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।ধানমন্ডিতে মারা গেছে একাদশ শ্রেনীর ছাত্র ফারহান ফাইয়াজ, নরসিংদীতে তাহমিদ তামিম নামে এক স্কুল ছাত্র পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা গেছে। রাজধানীর নিউমার্কেটে মারা গেছেন শাহজাহান নামে একজন পাপোস বিক্রেতা। রাজধানী ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে মারা গেছেন তিন জন। এর মধ্যে একজন ছাত্রদলের নেতা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রদলের নেতা ওয়াসিম আন্দোলনে যাওয়ার আগে ফেসবুকে লিখেছিলেন ছাত্রদল তার প্রানের সংগঠন। এই পরিচয় আমি শহীদ হতে চাই। তার পরিবারের লোকজন চমেক হাসপাতালে গিয়ে তার লাশ সনাক্ত করেন এবং সে যে ছাত্রদল করতো না নিশ্চিত করেছেন। বাকি দুইজনের নাম পরিচয় এ রিপোর্ট লেখা পযন্ত জানা যায়নি।
এদিকে পুলিশ ছাত্র সংঘর্ষে বিভিন্ন স্থানে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অনেকেই আহত হয়েছেন। সারা দেশে বিভিন্ন তথ্য সূত্রের হিসেবে প্রায় তিন শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সদস্যদের উদ্ধারে র্যাবের হ্যালিকপ্টার ব্যবহার করতে দেখা গেছে।
গত ৫ জুন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। এই ঘোষনার পর থেকেই মুলত: আন্দোলনে দানা বাধঁতে থাকে। জুনের পর ধীরে ধীরে ছাত্ররা সরব হয় কোটা বাতিলের পক্ষে। এবং জুলাইয়ের ১০ তারিখের পর থেকে মূলত আন্দোলনের মাত্রা তীব্রতর হয়। যা আগুন সন্ত্রাস আর ব্যাপক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে চলতে শুরু করেছে। এর আগে ব্যাপক আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির পদে সরাসরি নিয়োগে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি তুলে দিয়ে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। কোটা বাতিলে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের একদিন পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ পরিপত্র জারি করে। এর বিরুদ্ধে দুই জন মুক্তিযোদ্ধা সন্তান আপীল করলে বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ছাত্ররা ফের আন্দোলনে রাস্তায় নামে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার কোটা আন্দোলন বিষয়ে বলেছেন , ‘আমি এ বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলছি না। তবে আমি বলব, ঢাকায় শিক্ষার্থী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়াকালে সংঘটিত সহিংসতার ওপর আমরা নজর রাখছি। পাশাপাশি বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের বিরুদ্ধে যে কোনো সহিংসতার ঘটনা নিন্দাজনক।
সরকার প্রথম থেকেই এই আন্দোলন দমনের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সরকারের তরফে বলা হয়েছে, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বাধা দেবে না সরকার। কিন্তু এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই ভিন্ন মাত্রায় রূপ নেয় কোটা বিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলনে ঢুকে পড়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা এমন অভিযোগ উঠেছে আওয়ামীলীগের তরফে । এছাড়াও জাতীয় পার্টি, জামায়াত, বিএনপি এবং হেফাজতে ইসলামী এই আন্দোলনে সরাসরি সমর্থন দেওয়ায় আন্দোলন ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হয়েছে। আন্দোলনে এখন যারা অংশ নিচ্ছে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় কি, কিভাবে শান্তিপূর্ন আন্দোলনে দেশীয় অস্ত্র আর লাঠিসোটা প্রবেশ করলো, কারা জ্বালাও পাড়োও তান্ডবে লিপ্ত সেই বিষয়গুলো সামনে এসেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক তন্ময় আহমেদ বলেছেন, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে এমন ছাত্ররা কোনো না কোনো ছাত্র সংগঠনের সদস্য অথবা সমর্থক। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক নেই অথবা ছাত্র রাজনীতি করে না এমন ছাত্র খুজে পাওয়া খুবই দুষ্কর। সেই হিসেবে সাধারন ছাত্ররা এই কোটা বিরোধী আন্দলোন করছে এটা আসলে একটা সত্য।আন্দোলনের যে মোটিভ তা কিন্তু সরল রেখায় নেই। সরকারের অপজিশনে যে সব রাজনৈতিক দল রয়েছে তারাও অন্তরালে থেকে এটাকে সরকার বিরোধী একটি আন্দোলনে রুপ দিতে চেস্টা করছে তাদের ছাত্র সংগঠনগুলো দিয়ে।
তিনি উদাহরন দিয়ে বলেন, চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ওয়াসিম কিন্তু ছাত্রদলের নেতা ছিলেন। এই আন্দোলনে তার প্রাণ গেছে। এটাও একটা উদাহরণ। এছাড়াও জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবির এই আন্দোলনে একটা বাড়তি গতি দেবে তাও অনুমেয়।নতুন বিষয় হচ্ছে হেফাজতের এই আন্দোলনে প্রকাশ্যে সমর্থন দান। তারা হাটহাজারিতে মাদ্রাসার ছাত্রদের রাস্তায় আন্দোলনে নামিয়েছে। এটাও সরকার বিরোধী আন্দোলনের একটি রুপ হতে পারে।
সরকারের তরফে বলা হয়েছে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই কোটা বিরোধী আন্দোলনে সরকারের নৈতিক সমর্থন রয়েছে। সরকারও আন্তরিক ভাবে চায় কোটা ব্যবস্থায় সংস্কার হোক। কোটা বিরোধী আন্দোলন বর্তমান আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সময়ের দাবি। বাস্তব দাবি। কোটার সংস্কার সরকার চায় , শিক্ষার্থীরা চায় তাহলে কারা এই আন্দোলনকে চাঙ্গা রেখে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চাচ্ছে।সেই বিষয়টিতে সজাগ থাকতে বলেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।