Sat, Mar 9 2024 - 4:55:12 PM +06

বিরল ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকলো ধূমকেতুর যাত্রা


News Image

বাংলাদেশ রেলওয়ের একজন কর্মকর্তার উদ্যোগ ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স প্রথম বর্ষ ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পেরেছিলো প্রায় ৭০০ শিক্ষার্থী।ওই কর্মকর্তার বিশেষ উদ্যোগ ও তার টিমের অন্যদের সহযোগিতার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের উৎসাহমূলক পদক্ষেপের সুবাদে নানা নাটকীয় ঘটনার মধ্যে দিয়ে পরীক্ষা শুরুর ২২ মিনিট আগেই ট্রেনটি ওই শিক্ষার্থীদের নিয়ে রাজশাহীতে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।এর জের ধরে গতকাল থেকেই সামাজিক মাধ্যমে প্রশংসায় ভাসছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার ।প্রশংসা করতে গিয়ে কেউ কেউ ভারতীয় ওয়েব সিরিজ ‘দ্য রেলওয়ে ম্যান’-এ ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার সময় রেল কর্মকর্তাদের ভূমিকার কথাও উল্লেখ করছেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে যাত্রা করেছিলো প্রায় ৭০০ ছাত্র ছাত্রী।ধুমকেতু এক্সপ্রেস ট্রেনে ঢাকা থেকে এসে বিকেল সাড়ে তিনটার ভর্তি  পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার কথা ছিলো তাদের ।কিন্তু মঙ্গলবার সকাল ছয়টায় রাজশাহীগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস ঢাকায় কমলাপুর স্টেশন থেকে ছাড়ার কথা থাকলেও যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। রেল ব্রোকেনের জন্য ধুমকেতু এক্সপ্রেস ঢাকা থেকেই বিলম্বে রওনা হয়।সকাল ১১ টায় হিসেব করে দেখা গেল ট্রেনটি বিকেল ৩:০০ টা নাগাদ রাজশাহী পৌঁছবে। কিন্তু আগের দিন ওই ট্রেনে কিছু কাজ করা হয়েছিল, যার পর যাত্রার দিন ভোরে আর ট্রেনটির ইঞ্জিন চালু করা যাচ্ছিলো না। প্রকৌশলীরা আপ্রাণ চেষ্টা করে ৯টা নাগাদ ইঞ্জিন সচল করতে সক্ষম হন।

এর মধ্যে তিন ঘণ্টার বিলম্ব দেখে পরীক্ষার্থীরা অনেকে স্টেশনের গার্ডদের কাছে যায় এবং বেলা ৩টার মধ্যে তাদের রাজশাহী পৌঁছানো দরকার বলে জানায়।

গার্ড তাৎক্ষণিক এসে বিষয়টি আমাকে জানায়। আমি সাথে সাথে ঢাকা কন্ট্রোলকে কল দিলাম এবং বললাম এই ট্রেন পথে নির্ধারিত কোনো স্টেশনে আর কোথাও দাঁড়াবে না।এমনকি ক্রসিং পড়লে এ ট্রেন বন্ধ না করে উল্টো দিক থেকে আসা ট্রেনকে আগেই বন্ধ করে রাখতে হবে। এভাবেই এটা চলবে, বলছিলেন অসীম কুমার ।

অবশেষে ট্রেনটি সোয়া নয়টায় ঢাকা ছেড়ে রওনা হল। ভেতরে উদ্বিগ্ন শত শত পরীক্ষার্থী আর বিভিন্ন স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়া অন্য যাত্রীরা।ট্রেনটি জয়দেবপুর ছাড়ার পর পুরোপুরি পশ্চিমাঞ্চলের দায়িত্বে এলে তালুকদার আরো সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি সরাসরি যোগাযোগ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সাথে।শুনে ভিবি বললেন, তিনি ছাত্রদের সুযোগ দেয়ার জন্য তার টিমের সাথে আলোচনা করবেন এখনই। আর আমাকে বললেন কিছুক্ষণ পরপর তাকে অগ্রগতি জানানোর কথা।

এদিকে ট্রেন এগিয়ে চলছিল। কিন্তু সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া পৌঁছানোর পর সোয়া তিন ঘণ্টা বিলম্বে রওনা দেয়া ট্রেনটির ইঞ্জিন আবার বিকল হয়ে পড়ে।অসীম কুমার-সহ অন্য কর্মকর্তারা তখন আশেপাশে কাছাকাছি কোথায় ভালো ইঞ্জিন আছে খুঁজতে শুরু করেন।

অসীম কুমার বলছিলেন, ট্রেনের চাকাই জ্যাম হয়ে গিয়েছিলো নড়ানোই যাচ্ছিল না। পরে ঈশ্বরদী থেকে অন্য একটি ট্রেনের ইঞ্জিন এগুতে বললাম। তবে দুটি ইঞ্জিন নিয়ে ওই লাইনে ব্রিজ থাকায় ট্রেন চালানো যায় না।

এর মধ্যে কর্মকর্তারা হিসেব করে দেখেন যে ওই অবস্থায় নতুন ইঞ্জিন এনে সেটি জোড়া দিয়ে যাত্রা শুরু করে রাজশাহী পৌঁছালেও ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ পাবে না শিক্ষার্থীরা।এর মধ্যে চিলাহাটি এক্সপ্রেস নামের আরেকটি ট্রেন উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়ে সেখানে পৌঁছালে অসীম কুমার সেই ট্রেনের ইঞ্জিন শিক্ষার্থীদের বহনকারী ধূমকেতু এক্সপ্রেসের সাথে সংযুক্ত করার নির্দেশ দেন।

সেটি করা হলো, কিন্তু এরপরও হিসেব করে দেখা গেলো রাজশাহীতে চারটার আগে পৌঁছানো কঠিন হবে।অসীম কুমার আবার ভিসির সাথে যোগাযোগ করে অনুরোধ করলেন পরীক্ষা কিছুক্ষণ পিছিয়ে দেয়ার জন্য। ভিসিও সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং বললেন সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।আমরা আসলেই ঝুঁকিই নিলাম। গতি বাড়িয়ে দিতে বললাম ট্রেনের। যে গতিতে চালানো হয়েছে তার জন্য এই ট্রেনটি যথাযথ ছিলো না। তারপরও বাচ্চাদের জন্য এই ঝুঁকি আমরা নিলাম।পুরো ট্রেনে মাইকিং করে অন্য যাত্রীদের বললাম যে সবাইকে রাজশাহী নিয়ে আমাদের ব্যবস্থাপনায় যার যার স্টেশনে পাঠাব। তারা যেন সন্তানদের জন্য এটুকু স্যাক্রিফাইস করেন। তারাও সহায়তা করলেন, বলছিলেন তালুকদার।

পথে আরো যেসব স্টেশনে ট্রেনটির যাত্রী নামানোর কথা ছিলো সময় বাঁচাতে সে সব স্টেশনে আর দাঁড়ালো না ট্রেনটি।এভাবে বিলম্ব আর নাটকীয়তাপূর্ণ ভ্রমণ শেষে বেলা তিনটা ৩৮ মিনিটে ট্রেনটি রাজশাহী পৌছায়। সেখানে নেমেই শিক্ষার্থী দ্রুত যার যার পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়ার চেষ্টা করে।বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দারুণ সহযোগিতা করেছেন। তাও কারো কারো ৫-১০ মিনিট দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা ঝুঁকিটা না নিলে ওদের পরীক্ষাই দেয়া হত না।আমাদের টিমের প্রতিটি মানুষ গভীর আগ্রহ নিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করেছে বলে এটা সম্ভব হয়েছে।

পরীক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে ট্রনটি অন্য ট্রেনকে বসিয়ে দিয়ে এগিয়ে আনছিলাম। ভাগ্য এতই খারাপ,  লাহেড়ী মোহনপুর স্টেশনে এসে ধূমকেতুর ইঞ্জিন ফেইল করে, চাকা ঘুরছে না । কি করা যায়, কি করা যায় পরীক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে শরৎনগরে বসা চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন কেটে এনে  ধুমকেতু আবার চালু করলাম।

হিসেবে করে দেখলাম ট্রেনটি বিকেল ৪ ঘটিকায় রাজশাহী পৌঁছবে, তখন পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে। মাননীয় ভিসি মহোদয়কে পরীক্ষার সময় পিছিনোর বিনীত অনুরোধ করলাম। তিনি আমাকে প্রায় ৪ বার ফোন করে ট্রেনের খবর নিলেন। ট্রেন সর্বোচ্চ অনুমোদিত গতিতে চলছে। দূশ্চিন্তা ছাড়ছে না। পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। উপায়ন্ত না দেখে আড়ানী স্টেশনের স্টপেজে ট্রেন না থামিয়ে থ্রু পাশ করলাম।

ঈশ্বরকে খুব একটা ডাকি না, পরীক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে জোড়ে জোড়ে ডাকা শুরু করলাম, একটু মানত ও করলাম। ঈশ্বর মনে হয় সদয় হলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনে ট্রেন থামিয়ে দিলাম, তখন বিকেল ৩/৩৮ ঘটিকা। দৌড় দৌড় হলে ঢুকতে হবে ৪ টার মধ্যে। ভিসি মহোদয়কে বিনীত অনুরোধ করলাম ছেলে মেয়েদের হলে ঢোকার সুযোগ দেয়ার জন্য। তিনি কথা রাখলেন এবং রেলওয়ের সবাইকে ধন্যবাদ দিলেন।ট্রেন পরিচালনায় পাকশী কন্ট্রোলে সার্বক্ষনিক ভাবে মনিটরিং করেন ডিআরএম(পাকশী)। এখন নিজেকে বেশ হালকা লাগছে।বিবিসি বাংলাকে এভাবেই পুরো বিষয়টা বলছিলেন অসীম কুমার।সূত্র:বিবিসি