হলি টাইমস রিপোর্ট :
দেশের অগ্রাধিকার ভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ জিএমডিএসএস এবং ইজিআইএমএনএস উন্নয়ন প্রকল্প থমকে গেছে। দীর্ঘ একযুগের বেশি সময়েও এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি শুধু দুর্নীতি আর অনিয়মের কারনে।
গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম (জিএমডিএসএস) হল সমুদ্রে জাহাজের জন্য স্বয়ংক্রিয় জরুরী সংকেত যোগাযোগের জন্য একটি বিশ্বব্যাপী ব্যবস্থা যা এসওএলএএস কনভেনশনের অংশ হিসাবে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও) দ্বারা তৈরি করা হয়েছে। এই সাংকেতিক যোগযোগ ব্যবস্থা বাস্তবায়নে এস্টাব্লিস্টমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইমস ডিসট্রেস অন্ড ইন্টিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম (ইজিআইএমএনএস) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে নৌ পরিবহন অধিদফতর।
উপকূল এলাকা থেকে গভীর সাগরের ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত নজরদারির আওতায় আনার লক্ষ্যে ৭টি রেডিও স্টেশন স্থাপনের জন্য ২০১৪ সালে প্রকল্প হাতে নেয় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। ওই প্রকল্পের আওতায় ঢাকায় একটি ১১ তলা ভবন, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, কুতুবদিয়া, নিঝুম দ্বীপ, কুয়াকাটা, চরকুকরিমুকরি, দুবলারচরে সাতটি কোস্টাল রেডিও স্টেশন হওয়ার কথা। প্রতিটি সাইটে ২টি ভবন ও একটি টাওয়ার বসানো হবে।
দক্ষিণ কোরিয়ান ঋণ ও জিওবি সহায়তায় ২০১৪ সালে সরকারি অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পটি ২০১৬ সালে সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারনে সেটা সম্ভব হয়নি। তিনবার সংশোধন করা হয় প্রকল্পের বাজেট এবং সময় বাড়ানো হয় ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত ।
দক্ষিণ কোরিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সামহী অবকাঠামো নির্মান এবং এলজি আইসিটির কাজ করে দেবে বলে চুক্তি হয়।
প্রকল্পের শুরু থেকে তিন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি শুরু হয়।প্রথমত সামহী কোম্পানির অসহযোগিতার মাধ্যমে কাজে ধীর গতি, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিম্নমানের কাজ এবং কাজ না করে বিল ভাউচারে টাকা তুলে নেওয়া আর এই প্রকল্পের পরিচালকসহ কয়েকজন কর্মকর্তার চরম আর্থিক দুর্নীতি।
গভীর সমুদ্রে জাহাজ চলাচলের ওপর নজরদারি এবং জাহাজের বিপদকালীন সময়ে সহযোগিতা করার জন্যই এই প্রকল্পটি মূলত শুরু হয় প্রথম প্রকল্প পরিচালক চীপ নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন জসিম উদ্দিনের হাত ধরে। প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ ভালোভাবে শুরু হলেও হঠাৎ বদল করা হয় জসিম উদ্দিনকে। প্রপাগান্ডা রয়েছে তখণকার সময়ের চীপ ইঞ্জিনিয়ার এসএম নাজমুল হক নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্মাকে ম্যানেজ করে এই প্রকল্পের পরিচালক পদ বাগিয়ে নেন। দুর্নীতির শুরু মূলত তখন থেকেই। নাজমুল হক ঘুষের টাকাসহ দুর্নীতি দমন কমিশনের হাতে আটক হন। চাকরী থেকে সাময়ীক বরখাস্ত হলেও তার দুর্নীতি থামেনি । নাজমুল হকের দ্বিতীয় স্ত্রী যিনি এই প্রকল্পের কম্পিউটার অপারেটর ছিলেন সেই নাসিরা সুলতানা এবং তার মেয়ের জামাইয়ের ঠিকাদারি লাইসেন্সে এই প্রকল্পে ব্যবসা করছেন তিনি । সেই নাজমুলের বিরুদ্ধেও কাজ ঠিকমতো না করে অবৈধভাবে টাকা উত্তোলনের অভিযোগ উঠেছে। নাজমুলের পর ফের প্রকল্প পরিচালক হন ক্যাপ্টেন জসিম উদ্দিন।জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে ৬২ কোট টাকার অডিট আপত্তি উঠেছে। অবসরে যাওয়ার পরিই জানা গেছে জসিম উদ্দিন কমপক্ষে ১৩ কোটি টাকা সরকারি অর্থ তছরুপ করেছেন। তার স্ত্রীর ভাগ্নে এই প্রকল্পের ডেপুটি নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন ফরহাদ জলিল বিপ্লবের বিরুদ্ধেও রয়েছ দুর্নীতির অভিযোগ ।
জসিম উদ্দিনের অবসরের পর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে অবৈধ ভাবেই প্রকল্প পরিচালক হন আবু সাঈদ মো: দেলোয়ার রহমান।রূলস অব রেগুলেশন অনুযায়ী একমাত্র তৃতীয় গ্রেডের কর্মকর্তারই প্রকল্প পরিচালক হতে পারবেন।কিন্তু সেই সময়ের মহাপরিচালক নিয়ম বহির্ভুত ভাবেই চতুর্থ গ্রেডের কর্মকর্তা দেলোয়ার রহমানকে প্রকল্প পরিচালক করেন। দায়িত্ব পেয়েই এই প্রকল্পের সরকারি অর্থ নিয়ম বহির্ভুতভাবে খরচ শুরু করেছেন দেলোয়ার রহমান। মহাপরিচালকের দফতর জানিয়েছেন, ২০২২-২৩ সালের চলতি সময় পযর্ন্ত ১৭ কোটি ১৮ লাখ ৬৬ হাজার টাকার মাত্র ৫ কোটি টাকা খরচে মহাপরিচালকের অনুমোদন রয়েছে। বাকি পুরো টাকাই তছরুপ করা হয়েছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন হলেও তাদের কাজ করতে দিচ্ছেনা দেলোয়ার রহমান।
২০২২ সালের জুন নাগাদ অবকাঠামোগত কাজের সর্বোচ্চ অগ্রগতি হয়েছে ৩৫ শতাংশ। বর্তমান মহাপরিচালক কমডোর মো. নিজামুল হক দায়িত্ব গ্রহনের পর গেল নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এই চার মাসে ৭০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। এরপর থেকে বিভিন্ন প্রকার অনিয়ম ও দুর্নীতি কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রকল্পের কার্যক্রম।
এসব বিষয় জানিয়ে গত ২০ মার্চ নৌপরিবহন সচিবকে চিঠি লিখেন মহাপরিচালক ।
প্রকল্প পরিচালক আবু সাইদ মো. দেলোয়ার রহমানকে প্রতিস্থাপন প্রসঙ্গে পাঠানো ওই পত্রে তিনি উল্লেখ করেন, আগামী জুনের মধ্যে পূর্তের কাজ শেষ করা না হলে ইকুইপমেন্ট স্থাপনসহ প্রকল্প ২০২৪ সালের জুন মাসের মধ্যে সম্পন্ন করা অসম্ভব হতে পারে।
এদিকে ব্যাপক আর্থিক দুর্নীতির পর স্বেচ্ছায় প্রকল্প পরিচালকের পদ ছেড়ে দিতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন দেলোয়ার রহমান । তবে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা এখনো দেলোয়ারকে ওই পদ থেকে সরিয়ে দিতে রাজি নয় বলে জানা গেছে। অবৈধ নিয়োগের এই দায়ভার কেনো মন্ত্রণালয় নিচ্ছে সেই বিষয়টিও অস্পষ্ট।
দেলোয়ার রহমানকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নীতি অনুযায়ী না রাখার যে চিঠি মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে সেই বিষয়টি দুর্নীতিগ্রস্ত কয়েকজন কর্মকর্তা এবং ঠিকাদাররা ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। প্রকল্প পরিচালকসহ প্রকল্পের আরো দুই কর্মকতা এবং কোরিয়ান ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট দুর্নিতির অভিযোগে প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়ায় মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে একটি মহল বিভিন্ন অপপ্রচারে লিপ্ত । তারা মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। মহাপরিচালকের দফতর থেকে অবশ্য বলা হয়েছে, দুর্নীতি এবং অনিয়মকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া হবেনা। সরকারি অর্থ তছরুপে যারা জড়িত এবং তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।