সাগরিকা মন্ডল, বিশেষ প্রতিবেদক:
দুর্গা পূজা মানেই ছোট বেলার সেই নতুন নতুন তিন চার জোড়া জামা কাপড় চোপর কেনা। পুজার সময় ভালো ভালো ভালো খাওয়া দাওয়া। আর সারাদিন হইহুলোর করে ছুটে বেড়ানো। পড়াশোনা শিকেয় তুলে দেওয়া, আরও কত কি ! কালী পূজায় বেশী আনন্দ হয় বলে সারা বছর ধরে অপেক্ষায় থাকা হয় কবে কালী পূজা আসে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। আর কয়েক দিন পরেই সেই প্রতীক্ষার অবসান , তার পরই শুরু কালী পূজা। যদিও এ পূজা একদিন ব্যাপি হয় তবুও এর আনন্দমেলা থাকে ৭ দিন ।কালী গৃহে বা মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত কালীপ্রতিমার নিত্যপূজা হয়। এছাড়াও বিশেষ বিশেষ তিথিতেও কালীপূজার বিধান আছে। কালী বা কালিকা হলেন একজন হিন্দু দেবী। তাঁর অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি। প্রধানত শাক্ত সম্প্রদায় কালীপূজা করে থাকে। তন্ত্র অনুসারে, কালী দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত দশজন প্রধান তান্ত্রিক দেবীর প্রথম। শাক্ত মতে, কালী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি কারণ। বাঙালি হিন্দু সমাজে কালীর মাতৃরূপের পূজা বিশেষ জনপ্রিয়।
হিন্দু পূরাণ মতে, কালী দেবী দুর্গারই একটি শক্তি। সংস্কৃত ভাষার ‘কাল’ শব্দ থেকে কালি নামের উৎপত্তি। কালীপূজা হচ্ছে শক্তির পূজা। জগতের সকল অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে শুভশক্তির বিজয়মধ্যেই রয়েছে কালীপূজার মহাত্ম। হিন্দু সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব শ্রী শ্রী শ্যামা পূজা ।
কালী নামের ব্যুৎপত্তি -
কালী’ শব্দটি ‘কাল’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। এই শব্দের অর্থ ‘কৃষ্ণ’ (কালো) বা ‘ঘোর বর্ণ’। হিন্দু মহাকাব্য মহাভারত-এ যে ভদ্রকালীর উল্লেখ আছে, তা দেবী দুর্গারই একটি রূপ। মহাভারত-এ ‘কালরাত্রি’ বা ‘কালী’ নামে আরও এক দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ইনি যুদ্ধে নিহত যোদ্ধৃবর্গ ও পশুদের আত্মা বহন করেন। আবার হরিবংশ গ্রন্থে কালী নামে এক দানবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘কাল’ শব্দের দুটি অর্থ রয়েছে: ‘নির্ধারিত সময়’ ও ‘মৃত্যু’। কিন্তু দেবী প্রসঙ্গে এই শব্দের মানে "সময়ের থেকে উচ্চতর"। সমোচ্চারিত শব্দ ‘কালো’র সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক না থাকলেও, সংস্কৃত সাহিত্যের বিশিষ্ট গবেষক টমাস কবার্নের মতে, ‘কালী’ শব্দটি ‘কৃষ্ণবর্ণ’ বোঝানোর জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে
কালী পূজা সময় -
আশ্বিন মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপান্বিতা কালীপূজা, মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে রটন্তী কালীপূজা এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে ফলহারিনী কালীপূজা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও শনি ও মঙ্গলবারে, অন্যান্য অমাবস্যায় বা বিশেষ কোনো কামনাপূরণের উদ্দেশ্যেও কালীর পূজা করা হয়। দীপান্বিতা কালীপূজা বিশেষ জনপ্রিয়। এই উৎসব সাড়ম্বরে আলোকসজ্জা সহকারে পালিত হয়। তবে এই পূজা প্রাচীন নয়। ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে কাশীনাথ রচিত শ্যামাসপর্যাবিধি গ্রন্থে এই পূজার সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। কথিত আছে, নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় অষ্টাদশ শতকে তাঁর সকল প্রজাকে শাস্তির ভীতিপ্রদর্শন করে কালীপূজা করতে বাধ্য করেন। সেই থেকে নদিয়ায় কালীপূজা বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্রও বহু অর্থব্যয় করে কালীপূজার আয়োজন করতেন
একাধিক রূপভেদে দেবী কালী-
তন্ত্র পুরাণে দেবী কালীর একাধিক রূপভেদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তোড়লতন্ত্র অনুসারে, কালী আট প্রকার। যথা: দক্ষিণকালিকা, সিদ্ধকালিকা, গুহ্যকালিকা, শ্রীকালিকা, ভদ্রকালী, চামুণ্ডাকালিকা, শ্মশানকালিকা ও মহাকালী।মহাকাল সংহিতার অনুস্মৃতিপ্রকরণে নয় প্রকার কালীর উল্লেখ পাওয়া যায়। যথা: দক্ষিণাকালী, ভদ্রকালী, শ্মশানকালী, কালকালী, গুহ্যকালী, কামকলাকালী, ধণকালিকা, সিদ্ধিকালী, সিদ্ধিকালী, চণ্ডিকালিকা। অভিনব গুপ্তের তন্ত্রালোক ও তন্ত্রসার গ্রন্থদ্বয়ে কালীর ১৩টি রূপের উল্লেখ আছে। যথা: সৃষ্টিকালী, স্থিতিকালী, সংহারকালী, রক্তকালী, যমকালী, মৃত্যুকালী, রুদ্রকালী, পরমার্ককালী, মার্তণ্ডকালী, কালাগ্নিরুদ্রকালী, মহাকালী, মহাভৈরবঘোর ও চণ্ডকালী।জয়দ্রথ যামল গ্রন্থে কালীর যে রূপগুলির নাম পাওয়া যায়, সেগুলি হল: ডম্বরকালী, রক্ষাকালী, ইন্দীবরকালিকা, ধনদকালিকা, রমণীকালিকা, ঈশানকালিকা, জীবকালী, বীর্যকালী, প্রজ্ঞাকালী ও সপ্তার্নকালী ।
মা কালীর ধ্যান মন্ত্র-
সংস্কৃত_ধ্যান মন্ত্রঃ-
ওঁ করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাম্ ।
কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুন্ডমালাবিভূষি তাম্।।
সদ্যশ্চিন্নশিরঃ খড়গবামাধোর্দ্ধক রাম্বুজাম্ ।
অভয়ং বরদঞ্চৈব দক্ষিণোদ্ধার্ধপাণিকাম্।।
মহামেঘপ্রভাং শ্যামাং তথা চৈব দিগম্বরীম্ ।
কন্ঠাবসক্তমুন্ডালী-গলদ্রুধিরচর্চিতাম্ ।
কর্নাবতংসতানীতশ বযুগ্মভয়ানকাম্ ।।
ঘোরদ্রংষ্টাং করালস্যাং পীণোন্নতপয়োধরাং
।
শবনাং করসংঘাতৈঃ কৃতকাঞ্চীং হসন্মখীম্ ।।
সৃক্কদ্বয়গলদ্রক্ত-ধারাবিস্ফুরিতাননাম্ ।।
ঘোররাবাং মহারৌদ্রীং শ্মশ্মানালয় বাসিনীম্ ।
বালার্কমণ্ডলাকা রলোচনত্রিয়ান্মি তাম্ ।।
দস্তুরাং দক্ষিণব্যপিমুক্ তালম্বিকচোচ্চয়া ম্ ।
শবরূপমহাদেবহৃদয় োপরি সংস্থিতাম্ ।।
শিবাভির্ঘোররাবা ভিশ্চতুর্দিক্ষু সমন্বিতাম্ ।
মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাম ।।
সুখপ্রসন্নবদনাং স্মেরানন সরোরুহাম্ ।
এবং সঞ্চিন্তেয়ৎ কালীং সর্বকাম- সমৃদ্ধিদাম্ ।।
মন্ত্রের অনুবাদ-
দক্ষিণা কালী করালবদনা ঘোরা, মুক্তকেশী ও চতুর্ভুজা, দিব্য জ্যোতি সম্পূর্ণা দেবী মুন্ডমালা ধারিণী । মায়ের বামদিকের নিচের হাতে সদ্যচ্ছিন্ন মুন্ড, উপরের বাম হাতে খড়গ । ডানদিকের উপরের হাতে অভয় এবং নিচের হাতে বরমুদ্রা ধারণ করে আছেন । মায়ের গায়ের রং কাল মেঘের প্রভার মত শ্যামা । তিনি দিগম্বরী মানে বস্ত্রহীণা । উনার গালার মুন্ডমালা গুলো থেকে বের হওয়া রক্ত উনার দেহ কে রন্জিত করছে, দুটি শবশিশু তার কর্ণভূষণ হওয়াতে দেবীকে ভয়ঙ্করী দেখাচ্ছে । তিনি তার করাল দন্ত দিয়ে নিজের জিহ্বা তে কামড় দিয়ে আছেন, হাতের মালা তিনি কোমড়ে বেঁধে রেখেছেন । তিনি মৃদুহাসি দিয়ে থাকেন এবং উনার মুখ থেকে রক্তের ধারা বের হচ্ছে আর উনার মুখে অনন্ত কোটি সূর্যের তেজ বিদ্যমান । তিনি অতিশয় ক্রোদ্ধা, ভয়ংকর নাদকারিণী, উনার তিনটি চোখ আর সেই সকালের সূর্যের মত লালপ্রভাময় । দেবী শবরুপ মহাদেবের হৃদয়ের মধ্যে দাড়িয়ে আছেন । উনার চারদিকে চিতকারী শিয়ালের দল । তিনি মহাকালের সাথে বিপরিতরাতুরা, তিনি সুখ প্রসন্ন মুখ তার । তিনি মোক্ষদায়িনী এবং সকল ইচ্ছাপূরণকারিণী
মা কালীর প্রনাম মন্ত্র-
জয়ন্তী মঙ্গলা কালীভদ্রা কালী
কপালিনী দূগা শিবা সমাধ্যাতীসাহা
সুধা নমস্তুতে।