
শেরপুর প্রতিনিধি
হলিটাইমস ডটকম
শেরপুর: বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী গারো পাহাড়ের শেরপুর জেলার অংশের ২০ হাজার ৪৯ একর বনভূমি ও পাহাড় জলবায়ু পরিবর্তন এবং এক মানবসৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞের কারণে অর্থাৎ এক শ্রেণীর পাহাড় ও বনখেকোর লোলুপ দৃষ্টিতে উজাড় হতে চলেছে।
গারো পহাড়ের ঐতিহ্য হারানোর পাশাপাশি বিলুপ্ত হচ্ছে জীববৈচিত্র। এসব বনাঞ্চলে ২০ বছর আগেও দিনের বেলায় সূর্যের মুখ দেখা যেত না। আর বর্তমানে বনাঞ্চল উজাড়ের ফলে গারো পাহাড় এখন ন্যাড়া পাহাড়ে পরিণত হয়েছে।
আবার কোথাও কোখাও বন উজাড়ের ফলে ফুটবল খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। বনবিভাগ ও সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, জেলার সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার মধুটিলা, রাংটিয়া ও বালিয়াজুড়ি এই তিনটি রেঞ্জের আওতায় রয়েছে উল্লেখিত বনাঞ্চল।
এক সময় এই পাহাড় ও বনাঞ্চলে ছিল সেগুন, শাল-গজারি, কড়ই, গামারি, গর্জন, জারুল, মেহগনির মতো মূল্যবান গাছ। এছাড়াও ছিল আম, জাম, কাঁঠাল, বড়ই, আমলকী, বহেরা, হরীতকীসহ বিভিন্ন ফলদ ও ঔষধি গাছ। এক সময় এই গারো পাহাড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কবিরাজ বা হেকিমরা ছুটে আসতেন নানা প্রজাতির ঔষধি গাছের জন্য। এছাড়া এই গারো পাহাড় এলাকাতেও ছিল অসংখ্য কবিরাজ।
কিন্তু সেসব গাছ গাছড়া এখন বিলুপ্ত হওয়ায় ওই সব কবিরাজরাও তাদের পেশা ছেড়ে দিয়েছে এবং মানুষও আয়ুর্বেদি চিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। বর্তমানে ওইসব প্রজাতি গাছের অনেকগুলোই এখন কতিপয় গাছ ও কাঠ ব্যাবসায়ী এবং বনদস্যুদের অবাদে গাছ কাটার কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সামান্য কিছু প্রজাতির গাছ থাকলেও সেগুলোও এখন বিলুপ্তির পথে। এক সময় এই গারো পাহাড়ে বাঘ, ভাল্লুক, হরিণ, বানর, হনুমান, সজারু, ময়ূর, টিয়া, ময়না, খোরগোশ, শূকর, বন মুরগি, বিভিন্ন প্রজাতির সাপসহ অসংখ্য পশু-পাখির অবাধ বিচরণ ছিল। অবাধে পরিবেশ ধ্বংস করে গাছ আর পাহাড় কাটসহ পশু-পাখি শিকারিদের দৌরাত্ম্যের কারণে ওইসব পশু-পাখি অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে কালেভাদ্রে বানর, বন মোড়গ, শূকর, কাঠবিড়ালি আর সামান্য কিছু সাপের দেখা মেলে বলে স্থানীয় এলাকাবাসী ও বন কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে।
শেরপুরের গারো পাহাড়ে ওইসব পশু-পাখির বিচরণের কথাটি বর্তমান প্রজন্মের কাছে কল্পকাহিনী বা ইতিহাস মাত্র। সীমান্তের পাহাড়ি এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার হাতি পাগাড়, বারোমারি, সমশ্চুড়া, মধুটিলা, ঝিনাইগাতী উপজেলার মরিয়মনগর, হলদিগ্রাম, সন্ধ্যাকুড়া, রাংটিয়া, হালচাটি, বড় গজনি, ছোট গজনি, বাকাকুড়া, দুধনই, তাওয়াকুচা, শ্রীবরদী উপজেলার বালিজুড়ী, রাজার পাহাড়, কর্ণঝোরা, খ্রিস্টানপাড়া, খাড়ামোড়া, রাঙ্গাজান, হাড়িয়াকোনা, বাবলাকোনাসহ বিভিন্ন পাহাড়ি ও সমতল বনভূমিতে এক সময় অসংখ্য বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ, বানর ও হনুমান দেখা যেত। পাহাড়ে এক জাতীয় চাম কাঁঠাল (ছোট ছোট আকারের কাঁঠাল) এবং পাহাড়ি কলা ছিল ওইসব বানর ও হনুমানের প্রধান খাদ্য।
কিন্তু সেসব ফলের গাছ উজাড় হওয়ার ফলে বানর ও হনুমান খাদ্য সংকটে পড়ে এর মধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। একইভাবে হরিণও বিলুপ্ত হয়েছে খাদ্য সংকট এবং শিকারিদের খড়গে পড়ে। এছারা বাঘ-ভাল্লুকসহ অন্যান্য জীবজন্তু বিলুপ্ত বা পাহাড় ছেড়েছে গভীর জঙ্গলের আবাসস্থল লোকলয়ে পরিণত হওয়ায়। অপরদিকে, বনের বিভিন্ন প্রজাতির পাখ-পাখালি তাদের বসবাসের উপযোগী ও পরিবেশবান্ধব গাছ-গাছালি হারিয়ে যাওয়া এবং অবাধ বৃক্ষনিধনের ফলে এখন গারো পাহাড় এলাকায় কোনো পাখ-পাখালির কলরব শোনা যায় না। এলাকাবাসীর অভিযোগ, বনবিভাগের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বনদস্যু ও মুনাফালোভী কাঠ ব্যবসায়ীদের যোগসাজশে উজাড় হয়েছে বন।
এরপর ওইসব ন্যাড়া পাহাড়ে সরকার অংশীদার ভিত্তিতে সৃজনী বা উডলড বাগান তৈরি করা হচ্ছে গত প্রায় ১৫ বছর যাবৎ। ওইসব বাগানে দেশীয় প্রজাতির কোনো গাছ না লাগিয়ে পরিবেশবান্ধব নয় এমন ভিনদেশীয় আকাশমনি, ইউক্লিপটাস, বেলজিয়াম, মিনজিরিসহ নানা প্রজাতির গাছ রোপণের ফলে একদিকে পাহাড়ি মাটির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে ওইসব গাছে দেশীয় কোনো পাখি আবাসস্থল করতে না পেরে এবং তাদের খাদ্যের অভাবে পাখিদের অস্তিত্বও বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, নব্বই দশকের শুরুতে গারো পাহাড় এলাকায় প্রাথমিকভাবে স্থানীয়রা প্রথমে পাহাড় কেটে পাথর উত্তোলন শুরু করলে ওই বছরেই পাহাড় ধসে ও মাটিচাপা পড়ে কয়েক ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর তৎকালীন সরকার পাথর উত্তোলন বন্ধ করে দেয়। উল্লেখ্য, জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার সমশ্চূড়া, বুরুঙ্গা, কালাপানি, বাতকুঁচি, বারোমারি, দাওধরা, ডালুকোনা, কাঁটাবাড়ী, পানিহাতা, ঝিনাইগাতী উপজেলার রাংটিয়া, সন্ধ্যাকুড়া, হালচাটি, নকশি, বাঁকাকূড়া, গজনি, তাওয়াকুচা, গাঁন্ধিগাঁও শ্রীবরদী উপজেলার কর্ণঝোড়া, বালিজুড়ি, খারামোড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৩০-৪০ ফুট গর্ত করে এবং পাহাড় কেটে অবাধে পাথর উত্তোলন করে গারো পাহাড় ধ্বংস এবং পাহাড়ের সৌর্ন্দয নষ্ট করা হয়েছে। এছাড়া উল্লেখিত এলাকার বেশ কিছু জায়গায় একটি প্রভাবশালী মহল অবৈধভাবে মূল্যবান চীনামাটি বা সাদামাটি ও কাচ বালি উত্তোলন করে দেশের মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের মহোৎসবে মেতে ওঠে।
পরবর্তীতে ওইসব পাহাড় কাটাও বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। জেলায় গত ২০ বছরে সরকারি হিসেবে মাটিচাপায় ৩০ শ্রমিকের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হলেও স্থানীয় সূত্রমতে, মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৭০ এবং পঙ্গু ও আহত হয়েছেন শতাধিক শ্রমিক। অপরদিকে ওইসব পাথর ব্যবসায়ী বেকার হওয়া পাথর শ্রমিকদের ক্ষেপিয়ে তুলে তাদের দিয়ে বন ধ্বংসে নামিয়ে দেয়। ফলে গত তিন-চার মাস ধরে শুরু হয়েছে গাছ কাটার মহোৎসব।
গারো পাহাড়ের নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার বিভিন্ন শাল-গজারি বাগান ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে প্রতি রাতেই মূল্যবান গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে ওইসব গাছ চোর সিন্ডিকেট সদস্যরা। বিশেষ করে জেলায় গজনি বিটে বর্তমান বিট অফিসারের ছত্রছায়ায় ব্যাপকভাবে চলছে গাছ কাটার মহোৎসব।
সূত্র জানায়, ওই সিন্ডিকেট চক্র বন বিভাগের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং পুলিশ ও বিডিআর সদস্যদের যোগসাজশে নির্বিঘে চালিয়ে যাচ্ছে গাছ কাটা। তবে লোক দেখানো ভান করে প্রশাসন মাঝেমধ্যে দুয়েকটি কাঠের চালান আটক করলেও তা আবার গোপনে ছাড়িয়ে নিয়ে যায় ওই সিন্ডিকেট চক্র। শেরপুর শহরের প্রভাবশালী মহল বিভিন্ন কনস্ট্রাকশন কাজে এবং ব্যক্তিগত বহুতল বাড়ি নির্মাণে পাইলিং করতে প্রকাশ্যে গজারি গাছ ব্যবহার করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থাকছে নীরব।
সূত্র আরো জানায়, বনবিভাগ চুরি যাওয়া গাছের চিহ্ন মুছে ফেলতে রাতারাতি চুরি যাওয়া গাছের গুঁড়ি উপড়ে ফেলে। এছাড়া বন বিভাগের নিয়ম অনুযায়ী বনের কোনো গাছ চুরি গেলে তা নিকটস্থ থানায় জিডি করতে হয়। কিন্তু বন বিভাগ তা করেন না। তবে গাছ চুরির ব্যাপারে বন বিভাগের সঙ্গে বনিবনা না হলে এবং তাদের স্বার্থে কেউ ব্যাঘাত ঘটালে তাদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক গাছ চুরির মামলা ঠুকে দেন বলে পাহাড়ি এলাকার একাধিক নিরীহ গ্রামবাসী অভিযোগ করেছেন।
ঝিনাইগাতী উপজেলার গান্ধিগাঁও গ্রামের আব্দুল জলিল বলেন, বন এলাকায় যেদিন শেরপুর-ময়মনসিংহ বা ঢাকা থেকে বন বিভাগের বড় কর্তারা বন পরিদর্শনে আসে ওই রাতেই শুরু হয় গাছ কাটার মহোৎসব। এর কারণ হিসেবে তারা জানায়, বন বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা বনে এলে তাদের আপ্যায়ন বাবদ খরচ ও সেলামি দিতে সংশ্লিষ্ট বিট অফসারকে। ফলে ওই খরচের টাকা তোলার জন্য স্থানীয় অসাধু গাছ ব্যাবসায়ীর সঙ্গে চুক্তি করে ওই রাতেই বেশ কিছু গাছ কেটে বিক্রি করে তাদের খরচ তোলেন।
ঝিনাইগাতী উপজেলার রাংটিয়া রেঞ্জের গজনি বিট অফিসার মো. শাহনশাহ আলম তার এলাকায় গাছ কাটার মহোৎসবের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। এদিকে বনবিভাগের বিরুদ্ধে আনীত সব আভিযোগ অস্বীকার করে রাংটিয়া রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, বর্তমানে পাহার কাটা বন্ধ রয়েছে। তবে লোকবল সংকটের কারণে বনের গাছ কাটা রোধ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
শেরপুরের পরিবেশ বিদদের অভিমত, অবিলম্বে গারো পাহাড় রক্ষায় সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। সেইসঙ্গে অবাধে পাহাড় ও বন কাটা বন্ধ করে দেশীয় প্রজাতি ফলমূলসহ নানা বনজ ও ওষুধি গাছ রোপণ করে এবং বনায়ন করে হারিয়ে যাওয়া জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে তারা মনে করছে